মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
পরিবার হচ্ছে মানব সমাজের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জিন্দেগীর বহু শরয়ী বিধানের বিচরণক্ষেত্র হচ্ছে পারিবারিক জিন্দেগী। সঠিক ইসলামী পরিবার গঠনের উপরই মূলত নির্ভর করে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জিন্দেগীর কামিয়াবীর সিংহভাগ। পারিবারিক জিন্দেগীর বীজ বপন হয়ে বিয়ে-শাদীর মাধ্যমে একজন নারী ও একজন পুরুষ যখন তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করে। সাধারণত একটি বর্ধিত পরিবারের একটি শাখা বা প্রশাখা হিসেবে এর উৎপত্তি ঘটলেও সময়ের ব্যবধানে এবং পর্যায়ক্রমে এ দাম্পত্য জীবন একটি আলাদা অস্তিত্ব অর্জন করে। নিজেই মূল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আবার শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি করে। হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে মানব সন্তানের বিকাশ ও বিস্তৃতির এটাই হচ্ছে চিরন্তন প্রাকৃতিক উপায়। “ফিত্তারুতাল্লাহেল্লাতি ফাতারান্নাসা আলাইহা’’-এটাই আল্লাহর প্রকৃতিগত বিধান, যার উপর তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন-(সূরা আররূম:৩০)। পরিবারের মুল ভিত্তি দাম্পত্য জীবনকে যদি ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গঠন করা যায়, তাহলে সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে বিস্তৃত বর্ধিত পরিবারকেও ইসলামের আলোকে গঠন করা সহজ হবে। আর যদি দাম্পত্য জীবনে গলদ ঢুকে যায় এবং ইসলামী আদর্শের কমতি হয়ে যায়, তাহলে বর্ধিত পরিবারের ইসলামীকরণ কঠিন হয়ে যাবে।
আদর্শ পরিবার গঠনের পরিকল্পনা কখন থেকে এবং কিভাবে নিতে হবে? বিয়ে শাদীর পূর্বেই অর্থাৎ পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময়েই আদর্শ পরিবার গঠনের প্রথম এবং অন্যতম প্রধান কাজটি করতে হয়। স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করার ক্ষেত্রে দ্বীনদারীর বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানের জন্য হাদীস শরীফে তাগিদ প্রদান হয়েছে। সৌন্দর্য, বংশ বা সামাজিক মর্যাদা অথবা সম্পদ এসব মানুষের কাছে আপাতত আকর্ষণীয় মনে হলেও দ্বীনদারী বাদ দিয়ে শুধু এগুলোর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে আদর্শ পরিবার গঠনের প্রধান উপাদানেই ভেজাল ঢুকে গেলো। পাত্রী নির্বাচনের সময় শুধু আপনার স্ত্রীই নির্বাচন করছেন না, আপনার সন্তানের ‘মা’-ও নির্বাচন করছেন একই সাথে। কাজেই গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে- আপনার সন্তানদের জন্য কেমন মা নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। শুধু পাত্রী নির্বাচন নয়, পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দ্বীনদারীকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। এজন্য সাহাবায়ে কেরাম পাত্র/পাত্রী নির্বাচনের সময় তাঁদের দ্বীনী জ্ঞান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। কতগুলো সূরা মুখস্থ আছে, জিজ্ঞেস করতেন। আমাদের সমাজে আজকাল লেখাপড়ায় কি ডিগ্রী আছে খবর নেয়া হয়। উচ্চ ডিগ্রীকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। বৈষয়িক ডিগ্রীটাই বড় কথা! ইসলামী জ্ঞান, আমল ও চরিত্রের বিষয়টি একেবারেই গৌণ। যা হোক, আমাদের মূল আলোচনা হচ্ছে, কিভাবে পরিবারের মাঝে সন্তান-সন্ততিদেরকে সঠিক ইসলামী তারবিয়াত প্রদান করার উপযোগী পরিবেশে তৈরী করা যায়। স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব, কর্তব্য অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করবো।
১. ঘর ও পরিবারে ইসলামী পরিবেশ বিরাজমান থাকলে সন্তান-সন্ততির জন্য সেটা হচ্ছে একটা বাস্তব ও অনুকরণীয় তারবিয়াত। কাজেই স্বামী, স্ত্রী উভয়ের জন্য রয়েছে এক্ষেত্রে কিছু আদাব। সেগুলো রক্ষা করলে সে ঘর ও পরিবারে আল্লাহর রহমত বেশি করে আসবে। অশান্তি ও পেরেশানী থেকে আল্লাহপাক হেফাজত করবেন।
স্বামীর করণীয় আদবসমূহ ঃ বাহির হতে বাড়িতে প্রবেশের সময় এমন কিছু যিকর ও দোয়া পড়া উচিত যাতে শয়তান কোন জায়গা না পায়। জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:)কে বলতে শুনেছেন, “তোমাদের কেউ ঘর বাড়িতে প্রবেশ করার সময় এবং খাওয়া শুরু করার সময় যদি (সংশ্লিষ্ট দোয়াসমূহ পড়ে) আল্লাহর যিক্র করে, শয়তান তার সঙ্গী-সাথীদের বলে, তোমাদের আজ থাকার জায়গাও নেই। খাবারের ব্যবস্থাও নেই। আর যদি প্রবেশের সময় দোয়া না পড়ে, শয়তান বলে : তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। যদি খাওয়ার শুরুতে দোয়া না পড়ে শয়তান বলে : তোমাদের থাকা খাওয়া উভয়েরই ব্যবস্থা হয়ে গেছে’’।-(মুসলিম)
ঘরে ঢুকেই সালাম করা এবং সবার সাথে হাঁসিমুখে কথা বলা। বিনা খরচে সওয়াব হাসিলের এগুলোই সুযোগ। স্ত্রী বা পরিবারের যে-ই থাকুক হাসিমুখে সাক্ষাতটি এনে দেবে আপনাকে অনেকগুলো সওয়াব। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “লা তাহকিরান্না মিনাল মা’রুফে শাইয়ান ওয়ালাও আন তালক্বা আখাকা বি ওয়াজহিন ত্বালেক’’- অর্থাৎ কোন নেক আমলকেই তুচ্ছ মনে করো না, এমনকি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাত করার ব্যারটিকেও-(মুসলিম) আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “যখন তোমরা ঘরে বাড়িতে প্রবেশ করো, তোমরা একে অপরকে সালাম প্রদান করো। সালাম হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য একটি পবিত্র ও বরকতময় শুভেচ্ছা’’- (সূরা নূর : ৬১) দুঃখের বিষয় হলো, অনেক সময় দেখা যায় যে, লোকটি বাইরে লোকজনের সাথে হাঁসি-খুশি, ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহার করছেন, ঘরে ফিরছেন বদ মেজাজী স্বভাব নিয়ে, স্ত্রী-পরিবার তার রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যান। কোন কিছু জিজ্ঞেস করা মাত্রই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন। একটা মানসিক সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়ে গেলো তিনি বাড়ি আসার সাথে সাথেই। ছেলেমেয়েরা ভয়ে যার যার কক্ষে আশ্রয় নিলো, পিতার মুখোমুখি যেনো না হওয়া লাগে। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রী-পরিবারের সাথে উত্তম ব্যবহার করে’’-(ইবনে মাজাহ)। রাসূলুল্লাহ (সা:) বাহির থেকে ঘরে এলে সালাম কালাম এর পরই মিস্ওয়াক করে নিতেন। কারণ, দীর্ঘক্ষণ বাইরে থাকলে ও খাওয়া দাওয়া না করলে মানুষের মুখে দুর্গন্ধ পয়দা হওয়ার আশংকা থাকে। এ সতর্কতা ও খেয়াল এজন্য যে, পরিবার-পরিজন যেনো তার কাছ থেকে আনন্দ ও খুশি ছাড়া কোন ধরনের কষ্ট না পান। এমন কি মুখের সামান্য দুর্গন্ধও যেন তাদেরকে কষ্ট না দেয়।
বলুন তো ভাই, স্ত্রী-পরিবারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আল্লাহর কাছ থেকে অফুরন্ত সওয়াব হাসিল করতে আপনার কত টাকা খরচ হবে? যে মহিলাটি আপনার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করছে, ঘুরে ঢুকে তার সাথে বদমেজাজ না দেখিয়ে মায়া, মমতা, সোহাগভরা দুটো কথা বলতে আপনাকে কতো পরিশ্রম করতে হবে? (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন