মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক : আজকের আলোচনা শুরু করতে চাই স্মৃতি রোমন্থন করে; গণতন্ত্র এবং নেতৃত্বের ঘটনা নিয়ে। ১৯৮৯ সালের জুলাই থেকে ১৯৯০ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাস, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া স্টেইট বা রাজ্যের কার্লাইল ব্যারাকস-এ (বাংলাদেশি পরিভাষায়: কার্লাইল সেনানিবাসে) অবস্থিত ইউনাইটেড স্টেইটস আর্মি ওয়ার কলেজে একজন আন্তর্জাতিক ফেলো হিসেবে অধ্যায়ন করি। শ’খানেক মার্কিন সামরিক ও অসামরিক অফিসার ছাড়াও, আরও প্রায় ২২ জন বিদেশি বা ভিন্ন দেশি সামরিক অফিসার, আমারই মতো আন্তর্জাতিক ফেলো হিসেবে অধ্যায়ন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ফেলোদের উপস্থিতির মাধ্যমে, জ্ঞান অর্জনের অঙ্গনটি ও মতামত বিনিময়ের মাধ্যমটি, একটি বৈচিত্র্যময় ফুলের বাগানে রূপ নেয়। সিলেবাসের অংশ হিসেবে অধ্যয়ন করতে হয় কিছু ইতিহাস, কিছু বর্তমান এবং কিছু ভবিষ্যৎ। ঐরূপ ইতিহাসের একটি জিনিস ছিল লিডারশিপ, ইতিহাসের আরেকটি জিনিস ছিল ‘ডেমোক্রেসি ইন ক্রিটিকাল টাইমস’। এই অংশের অধ্যয়নের সঙ্গে জড়িত ছিল যুদ্ধক্ষেত্র এবং যুদ্ধের মূল্যায়ন। তাই পেনসিলভেনিয়া স্টেইট এর অনর্ভুক্ত গেটিসবার্গ নামক ঐতিহাসিক যুদ্ধ ক্ষেত্রে সফর করতে গিয়েছিলাম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক গৃহযুদ্ধের কথা আজকের প্রজন্মের অনেকেই নাও জানতে পারে। আজ থেকে প্রায় ষোলো দশক পূর্বে, ১৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্রাহাম লিংকন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূলত দক্ষিণাংশে বা মার্কিন সমাজে বিরাজমান ও চালু কৃতদাস প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিলেন। ঐ আমলের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশের রাজ্য বা স্টেইট বা প্রদেশগুলো প্রেসিডেন্ট এর সিদ্ধান্ত অমান্য করতে চাইলো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হলো। দক্ষিণ ভাগ কৃতদাস প্রথার পক্ষে, কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং উত্তর ভাগ কৃতদাস প্রথার বিপক্ষে। দক্ষিণ ভাগ সশস্ত্রভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলো। আড়াই বছরেরে বেশি সময় ধরে ঐ গৃহযুদ্ধ চললো। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন ফেডারেল বাহিনী জয়লাভ করলো। জয়লাভের পর, গৃহযুদ্ধেরই একটি বিখ্যাত যুদ্ধক্ষেত্রে, মার্কিন সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তথা প্রেসিডেন্ট (আব্রাহাম লিংকন), উপস্থিত সৈন্যগণের সামনে এবং উপস্থিত কিছু অংশ জনগণের সামনে একটি বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন; তারিখ ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩। ঐ ঐতিহাসিক জায়গাটির নাম গেটিসবার্গ। যেমনটি একটু আগে লিখেছি, আমি গেটিসবার্গ সফর করেছি ১৯৯০ সালে।
গেটিসবার্গের ভাষণটি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়েছে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ হিসেবে। ঐ ভাষণের সর্বশেষ বাক্যটি একটি দীর্ঘ বাক্য ছিল। ঐ ইংরেজি দীর্ঘ বাক্যটি আমি হুবহু প্রথমে উদ্ধৃত করছি, পরে বাংলা ভাবার্থ দিচ্ছি। উদ্ধৃতি শুরু। ইট ইজ রাদার ফর আস টু বি হিয়ার ডেডিকেইটেড টু দি গ্রেট টাস্ক রিমেইনিং বিফোর আসÑদ্যট ফ্রম দিজ অনারড ডেড উই টেইক ইনক্রিজড ডিভোশান টু দ্যট কজ ফর হুইচ দে গেইভ দি লাস্ট ফুল মেজার অব ডিভোশানÑদ্যট উই হিয়ার হাইলি রিজল্ভ দ্যট দিজ ডেড শেল নট হ্যাভ ডাইড ইন ভেইন, দ্যট দিস নেশন আন্ডার গড শ্যল হ্যাভ এ নিউ বাথ অফ ফ্রিডম, এন্ড দ্যট গভর্নমেন্ট অফ দি পিপল বাই দি পিপল, ফর দি পিপল শ্যল নট পেরিশ ফ্রম দি আর্থ। উদ্ধৃতি শেষ। বাংলা ভাবার্থ: যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমরা বিজয়ী হয়েছি, এখানে দাঁড়িয়ে আমাদের আত্ম-উপলব্ধি করতে হবে এরকমÑযে সকল সম্মানিত ব্যক্তি প্রাণ দিল, তারা যে কারণ ও আদর্শের জন্য প্রাণ দিল সেটা অধিকতর সম্মানিতÑতাঁদের প্রাণদানকে মূল্যহীন বলা যাবে না; তাঁদের প্রাণদানের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতার ও মুক্তির অঙ্গনে নতুন জন্ম নিলাম এবং আমরা প্রত্যয় জ্ঞাপন করছি যে, সৃষ্টিকর্তার ছায়ার নিচে এই পৃথিবীর বুক থেকে, জনগণ কর্তৃক গঠিত সরকার, জনগণের জন্য গঠিত সরকার এবং জনগণের সরকার কোনোদিনও নিশ্চিহ্ন হবে না। ভাবার্থ শেষ।
আমার স্মৃতিতে গেটিসবার্গ এবং আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ আসার পেছনে একাধিক কারণ আছে। আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্র নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন। গণতন্ত্রের অন্যতম পিলার বা স্তম্ভ হচ্ছে সুশাসন এবং স্বচ্ছতা। সেই সুশাসন এবং স্বচ্ছতা স্থাপন করতে গিয়েই আব্রাহাম লিংকন সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মুখাপেক্ষি হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তির বলেই বলিয়ান হয়ে সংকট মোকাবিলা করেছিলেন। গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের, সামরিক শক্তি অর্জনের এবং পৃথিবিতে প্রাধান্য বিস্তারের পেছনে অণুঘটক। কিন্তু আব্রাহাম লিংকনের মুখের থেকে উচ্চারিত কথাটির মতো কোনো কথা কি আমাদের কোথাও উচ্চারিত হয়েছে? বহুবার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চারণ করেছেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উচ্চারণ করেছেন। সা¤প্রতিককালেও উচ্চারিত হচ্ছে হরদম। মানুষকে নিয়েই যত বক্তৃতা। কিন্তু সেই মানুষের অধিকারের খবর কী? আমি গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা তুলছি না। আমি অর্থনীতির দুটো সংবাদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।
সম্মানিত পাঠক স¤প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি গত কিছুদিন আগের প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠার দিকে। মে মাসের ৩ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় লাল কালিতে ছাপানো শিরোনাম ছিল: “সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার, জিএফআই প্রতিবেদনে ১০ বছরের চিত্র, ২০১৪-তেই গেছে বাহাত্তর হাজার কোটি টাকা, সবচেয়ে বেশি পাচার: মিথ্যা ঘোষণার আমদানী-রপ্তানীতে।” মে মাসের ৩ তারিখে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় উপরে ডানদিকে বড় অক্ষরে শিরোনাম ছিল: “দশ বছরে পাচার সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা।” মে মাসের ৩ তারিখের বণিকবার্তা প্রথম পৃষ্ঠার সবচেয়ে বড় অক্ষরের শিরোনাম ছিল: “দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানী খাতে অর্থ পাচার।” মে মাসের ৪ তারিখ মানবজমিন এর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় অক্ষরে মূল শিরোনাম ছিল: “৭২,০০০ কোটি টাকা পাচার: নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।” মে মাসের ৪ তারিখ প্রথম আলো পত্রিকার ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ডানদিকে বড় শিরোনাম ছিল: “বাংলাদেশ থেকেই অর্থ পাচারের হার বেশি।”
উপরের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা পত্রিকাগুলোতে যে তথ্যগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া; প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই)। জিএফআই একটি অলাভজনক সংস্থা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা মুদ্রা পাচার নিয়ে এই সংস্থা গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে থাকে। একইসাথে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে, প্রতিবছর তারা অর্থ পাচারের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এবারের প্রতিবেদনে দশটি বছরকে গুচ্ছ করে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জিএফআই প্রতিবেদনটির শিরোনাম হচ্ছে ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ২০০৫-২০১৪’। শিরোনামের বাংলা অনুবাদ করলে এইরূপ দাঁড়াবে: উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ: ২০০৫-২০১৪। এবারের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে পহেলা মে ২০১৭ তারিখে। জিএফআই প্রতিবেদনে ১৪৯ দেশের অবৈধ অর্থ প্রবাহের তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে বেছে নিয়ে, বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো সারমর্ম প্রকাশ করেছে। একটি পত্রিকায় ছক আকারে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সাতটি দেশ হলো, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত এবং শ্রীলংকা। অর্থ পাচারের গুরুত্ব বুঝতে হলে অর্থনীতির সাইজ বা পরিমাণ যেমন বুঝতে হবে, তেমনই বুঝতে হবে পাচারকৃত অর্থ মূল অর্থনীতির কত অংশ? একটি সাংসারিক উদাহরণ দিই। একজন ব্যক্তির মাসিক বৈধ ইনকাম পাঁচ হাজার টাকা, সেখান থেকে তিনি প্রতি মাসে একশো টাকা দান-খয়রাত করেন; এটা হলো তাঁর ইনকামের পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ। আরেকজন ব্যক্তির মাসিক বৈধ ইনকাম হলো এক লক্ষ টাকা, সেখান থেকে তিনি মাসিক দান-খয়রাত করেন এক হাজার টাকা। পরিমাণ হিসাব করলে একশো টাকা থেকে এক হাজার টাকা আনুপাতিকভাবে দশগুণ বেশি। কিন্তু প্রথম ব্যক্তি তার ইনকামের পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ দান করেছেন। অপরপক্ষে দ্বিতীয় ব্যক্তি তার ইনকামের একশো ভাগের এক ভাগ দান করেছেন। উদাহরণ শেষ। একই যুক্তিতেই দেশের অর্থনীতির সাইজ এবং পাচার করা টাকার অনুপাত বুঝতে হবে। উল্লিখিত সাতটি দেশের অর্থনীতির সাইজ বা আকার বা পরিমাণ সমান নয়। আফগানিস্তানের অর্থনীতির সাইজ আর ভারতের অর্থনীতির সাইজ সমান না বরং আকাশ-পাতাল তফাৎ। তাই আফগানিস্তান থেকে ১৯০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে যেটা আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক লেনদেনের শতকরা ২৪ ভাগ, অপরপক্ষে ভারত থেকে পাচার হয়েছে আফগানিস্তানের তুলনায় ১১গুণ বেশি অর্থ যথা ২৩৩৪ কোটি ডলার কিন্তু সেইটা ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনের শতকরা ৩ ভাগ মাত্র। তাহলে বোঝা যায় আমাদেরকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সেই অংকে যেমন নজর দিতে হবে, একইসাথে নজর দিতে হবে বাণিজ্যিক লেনদেনের শতকরা কতভাগ পাচার হয়েছে সেদিকে। এইরূপ হিসাব করলে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে আফগানিস্তান থেকে (শতকরা ২৪ ভাগ), দ্বিতীয় বেশি পাচার হয়েছে মালদ্বীপ থেকে (শতকরা ২৩ ভাগ), তৃতীয় বেশি পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৯১১ (নয়শত এগারো কোটি ডলার; প্রতি ডলার ৭৫ টাকা হারে পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৮,৩২৫ কোটি টাকা, যেটা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের শতকরা ১৩ ভাগ, চতুর্থ বেশি পাচার হয়েছে মালয়েশিয়া থেকে (শতকরা ১০ ভাগ), পঞ্চম বেশি পাচার হয়েছে থাইল্যান্ড থেকে (শতকরা ৪ ভাগ) ষষ্ঠ বেশি বা অপর ভাষায় দ্বিতীয় ন্যূনতম পাচার হয়েছে ভারত থেকে (শতকরা ৩ ভাগ) এবং সপ্তম বেশি বা ন্যূনতম পাচার হয়েছে শ্রীলংকা থেকে (শতকরা ৩ ভাগ)।
১৯৪৭ এর আগে, বর্তমান বাংলাদেশ রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও জনগোষ্ঠীভাবে ব্রিটিশ-ভারতের বঙ্গ বা বেঙ্গল নামক প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গ-ভাগকে সূত্র ধরে এই জনপদকে বলা হতো পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব বাংলা। ব্রিটিশ-ভারতের বঙ্গ বা বেঙ্গল নামের প্রদেশের জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ ছিল বাংলাভাষী, ধর্মীয় বিভাজনে শতকরা ৬০ ভাগ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলমান। সেই প্রদেশে, মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ মুসলমান হলেও, ঐ ৬০ ভাগের বিন্যাস ও ঘনত্ব (ইংরেজি পরিভাষায়: ডেনসিটি) বেশি ছিল বেঙ্গল নামক প্রদেশটির পূর্ব অংশে। বঙ্গ বা বেঙ্গল নামক প্রদেশটির মধ্যে, শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থনৈতিক বা শিল্প উন্নয়নে, পূর্ব অংশ বঞ্চিত ও অবহেলিত ছিল। শিক্ষা-দীক্ষায় অর্থনৈতিক কর্মকাÐে অগ্রসর ছিল হিন্দু স¤প্রদায় এবং তারাই রাজনীতি সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল বা ডোমিনেইট করতো।
১৯৪৭ এর পরে, পূর্ব পাকিস্তান নামক প্রদেশের মানুষগুলো সরল বিশ্বাসে পাকিস্তান নামক দেশে আত্মনিবেশ করলো। পাকিস্তান নামক দেশটি ভৌগোলিকভাবে দুইটি খÐে বিভক্ত ছিল। ভৌগোলিকভাবে বড় এবং জনসংখ্যায় কম হলেও পশ্চিম পাকিস্তান নামক খÐটির তুলনায় অধিক শিল্পোন্নত ছিল। পূর্ব পাকিস্তান নামক খÐটি কৃষিতে সমৃদ্ধ ছিল বেশি। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম কৃষি পণ্য ছিল পাট। পাটের অপর নাম ছিল সোনালী আঁশ। এই পাট রপ্তানী করেই, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার বৃহদাংশ উপার্জিত হতো। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যতম জনপদ ও জনগোষ্ঠী পাঞ্জাব তথা পাঞ্জাবীগণ, চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে অনেক বেশি অগ্রসর ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক চাকরি, বেসামরিক চাকরি, শিল্প স্থাপন তথা সার্বিক জাতীয় জীবনে তারা ডোমিনেইট করতো। ফলশ্রæতিতে পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মানুষ তথা বাঙালিগণ বঞ্চিত অবহেলিত এবং নিপিড়ীত ছিল। এইরূপ প্রেক্ষাপটেই, আওয়ামী লীগ নামক বিখ্যাত রাজনৈতিক দল, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা নামক একটি আর্থ-রাজনৈতিক প্রস্তাব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে উপস্থাপন করেছিল। বাঙালিগণ ক্রমশ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রতিবাদ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীগণ কর্তৃক অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের, সেই রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ। ৯ মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। আমি বলতে চাচ্ছি যে, বাংলাদেশের মানুষ বা বাঙালিগণ, ১৯৪৭ সালের আগে এবং ১৯৪৭ সালের পরে উভয় অবস্থাতেই বঞ্চিত, শোষিত, নিপিড়ীত ছিল। ১৯৪৭ সালের আগে বঞ্চিত শোষিত ও নিপিড়ীত হওয়ার মৌলিক কারণ ছিল, বাঙালি হলেও, বেঙ্গল নামক প্রদেশের পূর্ব অংশের মানুষগুলো ছিল মুসলমান। অপরপক্ষে ১৯৭১ সালের আগে বঞ্চিত শোষিত ও নিপিড়ীত হবার মৌলিক কারণ ছিল, মুসলমান হলেও, পূর্ব পাকিস্তান নামক প্রদেশের মুসলমানগণ ছিল বাঙালি। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগে শোষকের দৃষ্টিতে আমাদের অপরাধ ছিল আমরা মুসলমান এবং ১৯৪৭ এর পরে শোষকের দৃষ্টিতে আমাদের অপরাধ ছিল আমরা বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন যাত্রা শুরু করলাম।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী হোমোজিনিয়াস বা একই নৃ-তাত্তি¡ক উৎসের। বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ৯৮ ভাগ একই ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান, পরবর্তী আট থেকে নয় শতাংশ সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী; পরবর্তী এক বা দুই শতাংশ বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে আমরা ছিলাম মাত্র ২৩ বছর। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে বয়স এখন ৪৫ বছর শেষ করে ৪৬ বছর চলছে। এখন আমরা কার দ্বারা নিপিড়ীত হবো, বঞ্চিত হবো, শোষিত হবো এটি একটি প্রশ্ন। অথবা প্রশ্নটি এমনভাবেও করা যায়, আমরা কাকে নিপীড়ন করবো, কাকে বঞ্চিত করবো, কাকে শোষণ করবো? জাতীয়ভাবে আমরা যদি পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের কষ্ট বা ব্রিটিশ আমলের ৪৭-পূর্ব ৫০/৬০/৭০/৮০ বছরের কষ্ট মনে না রাখি, তাহলে সেটা আমাদেরই দুর্ভাগ্য। তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তথা অটোমেটিকালি তথা অতি স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, আমরা বাঙালিরাই বাঙালিদের টাকা-পয়সা চুরি করছি; আমরা বাঙালিরাই বাঙালিদেরকে বঞ্চিত করছি; বাঙালিদের উপর নিপীড়ন শোষণ করছি। তার মানে আমাদের অভ্যাস ও চিন্তায় কিছু ত্রæটি আছে। বাঙালি শব্দ ব্যবহার করার বদলে, বাংলাদেশি শব্দও বা বাংলাদেশি পরিচয়টিও ব্যবহার করা যায় অবশ্যই।
আমি এই কথাগুলো তুললাম এই জন্য যে, সম্মানিত পাঠক যেন নিজের মনকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন, প্রত্যেক পাঠকই যেন তার প্রতিবেশীকে প্রশ্ন করতে পারেন, আমরা প্রত্যেকেই যেন সমষ্টিগতভাবে নিজেদের অন্তরকে প্রশ্ন করি (সোউল সার্চিং) যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলো বা মাসগুলো বা বছরগুলোতে বা আজকের সময়ে, বাংলাদেশের জন্য এই মুক্তিযুদ্ধের মূল মর্মবাণী প্রযোজ্য ছিল কিনা? প্রযোজ্য আছে কিনা? প্রযোজ্য হবে কিনা? আমাদের মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকেও অর্থ পাচার হচ্ছে, শতকরা হিসাবে আমাদের থেকে বেশি বা আমাদেরকে থেকে কম। কিন্তু জ্বলন্ত সত্য হলো, ঐ তিনটি দেশের কোনোটিই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের শহীদগণের রক্তের সাথে বেইমানী করছি না তো?
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন