মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ধূমপানের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া

| প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : কয়েক হাজার বছর আগে আগুন জ্বালানোর কাজে তামাক পাতা ব্যবহার করা হতো। এর কারণ, তামাক পাতায় খুব তাড়াতাড়ি আগুন ধরে। রান্নাবান্নার কাজেও এ পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু মুশকিল ছিল যে, তামাক পাতা জ্বালালে এক ধরনের ধোঁয়া উৎপন্ন হতো। এতে অবশ্য আশপাশের মশা-পোকা-মাকড় পালিয়ে যেত। এই পাতার ব্যবহার ক্রমশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তার প্রধান কারণ এর ধোঁয়া। দেখা যায় এই ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করলে বেশ একটা মাদকতার সৃষ্টি করে। সেই থেকে মানুষ তামাক পাতাকে ধূমপানের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে।
আমাদের এ অঞ্চলে তামাক পাতার রফতানি শুরু হয় ১৭০০ শতাব্দীতে। ভারতের বাইরে পর্তুগিজরা এই পাতার ব্যবহার প্রথম শুরু করে। বর্তমানে সিগারেট, চুরুট, বিড়ি, পাইপ ও হুঁকো নানাভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, যাদের তৈরির একমাত্র উপাদান হলো তামাক পাতা। তামাক পাতার মধ্যে নিকোটিন নামক একটি অ্যালকালয়েড আছে, যা হৃদস্পন্দন ও রক্তের চাপ বাড়িয়ে দেয় বলে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তামাক পাতার রঙের সঙ্গে নিকোটিনের এক গভীর সম্পর্ক আছে। তামাক পাতার রঙ যত বেশি কালচে বা খয়েরি হবে তাতে তত বেশি নিকোটিন থাকবে। চুরুট বা হুঁকোর জন্য কালচে পাতা ব্যবহার করা হয় যার নিকোটিনের পরিমাণ ৩ থেকে ৭ শতাংশ। সে তুলনায় সাধারণ সিগারেটে ১ থেকে ৩ শতাংশ নিকোটিন থাকে। ধূমপান করার সময় যদি একটি আচ্ছাদন বা ফিল্টার ব্যবহার করা যায় তা হলে ধোঁয়া অনেক পরিশোধিত হয়ে তবেই শরীরে প্রবেশ করে। সিগারেটের তুলনায় বিড়ি, চুরুট ও পাইপে অনেক বেশি কড়া তামাক পাতা ব্যবহার করা হয়।
‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’ এই সতর্কবার্তা লেখা শুরু হয়েছে আমাদের দেশে বেশ ক’বছর থেকেই। ধূমপানে মুখ, দাঁত, জিভ ও ঠোঁটের ক্ষতি করে। ধূমপান থেকে ফুসফুসে, গলার নালিতে কর্কট রোগ হবার আশঙ্কা অত্যন্ত প্রবল থাকে। গর্ভবতী অবস্থায় মহিলারা ধূমপান করলে সিগারেটের ধোঁয়া শরীরের মধ্য দিয়ে প্লাসেন্টার ভেতর প্রবেশ করে এবং গর্ভস্থ সন্তানের রক্তে মিশে যেতে পারে। এর ফলে রক্তে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে এবং তা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাছাড়া ধূমপানে আসক্ত মহিলাদের গর্ভস্থ সন্তান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপুষ্ট ও ক্ষণজীবী হয় বলে চিকিৎসাবিজ্ঞান দাবি করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ধূমপান অকাল গর্ভপাতেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে চিকিৎসকরা হুঁশিয়ারি প্রায়শই দিয়ে থাকেন।
তবে হালফিলের বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, ধূমপানের সময় তামাকের পোড়া পাতার ধোঁয়ায় এনএনকে নামক একটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক বস্তু পাওয়া গেছে। নিকোটিন যখন পুড়তে শুরু করে তখন পোড়া ছাই থেকে এনএনকে বস্তুটির সৃষ্টি হয় সেটা নাকি কর্কট রোগের অন্যতম কারণ। বিজ্ঞানীরা শুধু বলেন না, দাবিও করেন যে, সিগারেটের ধোঁয়ায় শুধুমাত্র ১টি নয়, ৪০টিরও বেশি ক্ষতিকারক পদার্থ আছে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যেটা বলে বেড়াচ্ছেন সেটি হলো, কখনও ধূমপানে অভ্যস্ত হওয়া উচিত নয়। তারা একটি তত্ত¡ আবিষ্কার করেছেন। সেটি হলো, ঈরমধৎৎঃঃব ঃবষষং ঁঢ়ড়হ ুড়ঁৎ যবধৎঃ ধহফ ঢ়রপশং ুড়ঁৎ ঢ়ড়পশবঃ ধঃ ঃযব ংধসব ঃরসব. মোদ্দা কথা হলো ‘যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’।
সিগারেট যারা পছন্দ করেন না তাদের অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু যেসব মানুষ সিগারেট ছাড়া বাঁচতে পারবেন না বলে দাবি করে আসছেন তারা যেসব তত্ত¡ বা তথ্য পেশ করছেন সেগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত একবার বিচার করে দেখতে দোষ কী? সিগারেট সেবন করেন এমনি এক নব্য যুবকের উক্তি দিয়ে শুরু করা যাক। যুবকটি বলেছেন, ঈরমধৎবঃঃব রং ুড়ঁৎ বহবসু. ঝড় বি ংযড়ঁষফ নঁৎহ রঃ. যুবকটির সঙ্গে থাকা একদল অন্য যুবকরাও সঙ্গে সঙ্গে তাল ঠুকলেন; আমরা মানছি যে সিগারেট আমাদের শত্রæ, তাই তো আমরা সিগারেটকে পুড়িয়ে মারছি। যারা সিগারেটকে পুড়িয়ে মারার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজ, তারা কি সফল হবে তাদের উদ্দেশ্যকে শ্রেষ্ঠ রূপদান করতে? এর উত্তর ভবিষ্যতেই জানা যাবে, কিন্তু যা কখনও জানা যাবে না সেটা হল সিগারেটকে পুড়িয়ে মারতে কতজন বা কত সংখ্যক যুবক সিগারেটের মাদকতায় জীবনকে চিরবন্দি করলেন।
সিগারেটের মাদকতা শুধু মানুষকে চিরবন্দি করে রাখে না, সে যে চিরসঙ্গী হতে পারে তার অনেক অনেক প্রমাণ দাঁড়িয়ে আছে ‘কফি হাউসে’ রেজিস্ট্রারে। এই সেই ‘কফিহাউস’ যেখানে সকাল সকাল না এলে বসারই জায়গা মেলে না, আর যদি বসাই না গেল তবে হরেক রকমের চরিত্রগুলোর জন্ম হবে কী করে? তাই তো সাতসকাল কফি হাউসের দরজা খুলতে না খুলতেই ছুটে হাজির হন বিদগ্ধ নাট্যকার, সাহিত্যিক, কবি, পরিচালক এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকরা। এক কাপ গরম কফির সঙ্গে সিগারেট আর চোখ-কান খরগোসের মতো সজাগ রেখে চরিত্রগুলোর পেছনে ধাওয়া করা মুখে সিগারেট গুঁজে নাট্যকার খুঁজতে থাকেন এমন একটি সংলাপ যা পেলে তাঁর নাটকটি অ্যাকডেমি পুরস্কারে ভূষিত হবে, তেমনি কবি চাইছেন এমন একটি ছন্দ বা শব্দের দ্যুতি যা নাকি হাজার চেষ্টাতেও তার কলমে জুটছে না কিংবা কোনও সম্পাদক খুঁজছেন এমন একটি জ্বলন্ত ঘটনা, যা নাকি কালকের খবরের কাগজের শিরোনাম হবে। তবে কি একটি সিগারেটের এত বড় ক্ষমতা যে সে কোনও সংলাপ তৈরিতে শব্দের ছন্দ বা জুটি মেলাতে কিংবা জ্বলন্ত ঘটনাকে ধোঁয়ার তুলিতে শেষ টান দিতে পারে, নিশ্চয়ই পারে তা না হলে সিগারেট কোনও সোনার বাক্সে বন্দি হয়ে না থেকে হাত বদল হয় কেন? নাট্যকার থেকে সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক কিংবা সম্পাদকের হাতে আর গভীর রাতে সিগারেটের এক একটি পাফ যেন এক একটি চরিত্রের নতুন সৃষ্টিকার। শুধু সিগারেটই পারে কোন সাহিত্যিককে এমন একটি চরিত্র তাঁর কলমে তুলে দিতে যা কিনা হতে পারে এক চিরদিনের অমর চরিত্র-নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক কিংবা গোয়েন্দা কাহিনীকার শার্লক হোমসরা বারবার বলে গেছেন যে মানুষের চরিত্রগুলো রহস্যে ঘেরা আর সিগারেটের ধোঁয়ারাও রহস্যে আবৃত। তাই সিগারেটের ধোঁয়াই পারে প্রত্যেকটি চরিত্রের রহস্যের বেড়াজাল উন্মোচন করে খুঁজে বের করতে তার শক্তিশালী দিকগুলো এবং দুর্বল দিকগুলোকে আর এই দুইয়ের উৎকৃষ্টতায় সৃষ্টি হয় এক শ্রেষ্ঠ চরিত্রের।
সবার কথাই বোধহয় শেষ শুধু একজন ছাড়া, যিনি বললেন সিগারেট নিয়ে শেষ কথা। তিনি যা বলবেন বা বিধান দেবেন সেটাই হবে ‘শেষ রায়’। বড় কৌতূহল জাগে কে তিনি? তিনি এই জগতের সৃষ্টিকর্তার মানসপুত্র ‘চিকিৎসকবৃন্দ’, মানুষ যাদের মাথায় তুলে রাখে, আর ইতিহাস যাদের নিত্য পাতা উল্টিয়ে খোঁজে বলছেন, ‘যখন আমরা আপাদমস্তক সাদা এপ্রোনে মোড়া চিকিৎসক তখন আমরা সমস্ত মানুষকে বলব আপনারা নিজেকে সিগারেট থেকে দূরে রাখুন, কেননা সে এক নিঃশব্দ ঘাতক।’
ধূমপান একটা খারাপ অভ্যাস। এ থেকে ক্যানসারসহ নানা রোগ হতে পারে। তবে ইচ্ছা করলে ধূমপান ত্যাগ করা যায়। তার জন্য যা করতে হবে তা হলো, ধূমপান ছেড়ে দেয়ার দিন থেকে প্রচুর পানির পাশাপাশি ফলের রস খেতে হবে। শরীরে একটু বেশিমাত্রায় তরল প্রবেশ করলে নিকোটিন এবং অন্যান্য বিষবর্জ্য সাফসুতরো হবে। ধূমপানের আসক্তি ক্রমে কমতে থাকবে। ধূমপান ছেড়ে দেবার পর মদ, কফি এবং চিনি সমৃদ্ধ খাবারদাবার পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ কফি-মদ-সুগার এসব ধূমপানের ইচ্ছা জাগায়। ধূমপান ছেড়ে দেবার জন্য চর্বিযুক্ত খাবারদাবার ছাড়তে হবে। কেননা নিকোটিন বিদায় করার পর শরীরের বিপাকক্রিয়ার গতি শ্লথ হয়ে যাবে। রাতে খেয়ে ওঠার পর সিগারেটের জন্য মন আনচান করলেও নিজেকে সংযত রাখতে হবে। সিগারেটের বদলে গ্রিন টি বা পুদিনা পাতা দিয়ে চায়ের লিকার অথবা পিপার মিন্ট ক্যান্ডি খেতে হবে। সিগারেট-বিড়ি-তামাকজাত নেশা ছেড়ে দেবার পর দারুচিনি-লবঙ্গ খাওয়া যেতে পারে। তামাকহীন কৃত্রিম সিগারেট চলতে পারে। তবে সংযমী হবার প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়বদ্ধ হলে এসব বিকল্পের দরকার হবে না। ধূমপান ছেড়ে দেবার পর শরীরে কিছু অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। শরীর থেকে নিকোটিন বেরিয়ে যাবার জোরে এমনটি হতে থাকে। তবে ছাড়ার ২-৩ দিনের মধ্যে অধিকাংশ নিকোটিন শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
জীবনের, সমাজের, পরিবেশের জন্য সর্বোপরি এ পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের জন্য ধূমপান ছেড়ে অধূমপায়ী বনে যাওয়া সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ধূমপান তথা তামাক সেবনের মাধ্যমে ক্যান্সারে ভোগে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সবচেয়ে সহজ ও দুর্ভাগ্যজনক। অন্যদিকে, ধূমপান ছেড়ে বাড়তি আয়ু পাওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের দেশে প্রতি বছর যত লোকের ক্যান্সারে মৃত্যু হয়, তার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যুর কারণ এ ধূমপান। অনেকটা বিগবাজারের সেই অফারের মতো একটা কিনলে আরেকটি ফ্রি। ধূমপানের জোরে যারা ক্যান্সারে মারা যান তারা বেশিরভাগ ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যান। তামাক শুধু এক ধরনের ক্যান্সার উপহার দেয় না, বহু ধরনের ক্যান্সারের কারক। তামাক সেবনের জোরে খাদ্যনালী, স্বরনালী, কিডনি, অগ্ন্যাশয়, জরায়ুমুখের ক্যান্সার হয়। ধূমপান ছেড়ে দিলে ধূমপায়ীর চেয়ে বেশিদিন বাঁচা ছাড়াও নানা রোগভোগের আশঙ্কা কমবে। এটা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেয়া অভিমত। ১০ থেকে ১৫ বছর ধারাবাহিক ধূমপান চালিয়ে গেলে রোগেভোগে মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায়। কিন্তু যদি ছেড়ে দেয়া যায়, তাহলে ১০ বছর পরে গিয়ে যে মৃত্যু অবধারিত ছিল তা থেকে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়া যায়। তবে এজন্য সতর্ক থাকতে হয়। এদিকে ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্যানসার হলে ধূমপান বাদ দিলেও সে অকালমৃত্যুর আশঙ্কা ৩০-৫০ শতাংশ কমে যায়। গর্ভবতীরা যদি সন্তান নেবার পূর্বে গর্ভাবস্থায় তিন মাসের মধ্যে ধূমপান ছাড়তে পারেন, তাহলে ভ্রæণের অনিষ্ট হবে না, সন্তান কম ওজন নিয়ে আগেভাগে ভূমিষ্ট হবে না। গর্ভাবস্থায় নানা সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে। সংশ্লিষ্ট মহিলা ফুসফুস, হার্টের রোগভোগ আটকাতে পারবেন। ধূমপান ছাড়লে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হবার আশঙ্কা কমবে। হাঁপানির ব্যামো থেকে বাঁচবেন। শরীরের প্রতিরোধী শক্তি দুর্বল হয়ে ঘন ঘন রোগভোগে জীর্ণ হতে গিয়ে থাকলে তার বাড়বৃদ্ধিও আটকানো যাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন