শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

হেপাটাইটিস ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে

প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৮:১২ পিএম, ৯ আগস্ট, ২০১৭

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : পত্রিকায় দেখলাম “হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’তে আক্রান্তদের ৯০ ভাগই চিকিৎসার বাইরে”। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও ২৮ জুলাই ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস’ দিবস পালন করা হলেও হয়তো স্বল্প সংখ্যক মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সম্পর্কে জানতে পারছে। সচেতনতা বাড়াতে কেউ কেউ চেষ্টা করলেও বছরের পর বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও গণসচেতনতা বাড়ছে না। যারা শহরে থাকেন তারা হয়তো কিছুটা সচেতন, অন্যদের কথা না বলাই ভালো। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এমনকি তারা নানা অজুহাতে গণমাধ্যম থেকেও দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অনাগ্রহ থাকার পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি সেবা কার্যক্রমও তেমন জোরদার নয়। এতে করে দেখা যায়, শহরের মানুষেরা খাদ্যজনিত অনিয়মের কারণে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা অনভিজ্ঞ চিকিৎসকদের খপ্পরে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। ঘাতক রোগ কখন এসে শরীরে বাসা বাঁধছে তার খবরও রাখা হয় না। লিভার আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলেও আত্মীয়-স্বজনরা জানেন না, কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে সে মারা যাচ্ছে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের মতো কিছু নিরব ঘাতক রোগ আছে, মৃত্যুই যার পরিণতি।
মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গের গুরুত্ব কম নয়। শরীর আল্লাহর এক নেয়ামত। তাই একে অবহেলা করার সুযোগ নেই। শরীরের ভেতরের অংশগুলো দেখা যায় না বলে তার সুস্থতার চিন্তা আসে না। দৃশ্যমান কোনো অঙ্গের কোনো সমস্যা হলে আমরা অধিক চিন্তিত হয়ে পড়ি, এটাই স্বাভাবিক। শরীরের ভেতরের অবস্থা খালি চোখে দেখা যায় না, সে কারণে বুঝতে পারি না সেটি কতটা সুস্থ বা অসুস্থ আছে। এমনই একটি অঙ্গ ‘যকৃৎ’। যকৃৎ শব্দটি বাংলা হলেও এর ইংরেজি নাম লিভারের সাথেই আমরা পরিচিত। একে চলতি বাংলায় কলিজা বলে। দেহের মধ্যে লিভার যে কাজ করে তার মধ্যে- পরিপাকে সহায়তাকারী পিত্তরস যা লিভার থেকে উৎপন্ন হয়। আর পিত্তরসে অবস্থিত পিত্তলবণ সোডিয়াম গøাইকোকোলেট ও সোডিয়াম টাউরোকোলেটের প্রভাবে চর্বির কণাগুলো ভেঙ্গে সাবানের ফেনার মতো দানায় পরিণত হয়। এছাড়াও দেহের আরও কিছু জৈব ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে লিভার। এ কারণে লিভারকে দেহের জৈব রসায়নাগারও বলা হয়। লিভার দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলেও লিভার কী, এটি কেন ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং লিভার আক্রান্ত হলে করণীয় কী, এ বিষয়ে আমরা অনেকেই তেমন কিছু জানি না। আর এসব বিষয় জানতে নিজের আগ্রহ না থাকলে কাউকে সচেতন করা যায় না।
ভাইরাসের মাধ্যমে লিভারে যে প্রদাহ হয় তাকে ভাইরাল হেপাটাইটাস বলে। ভাইরাল হেপাটাইটাস পাঁচ রকমের হয়ে থাকে। এ, বি, সি, ডি এবং ই। হেপাটইিটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। আর হেপাটইিটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ রক্তের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। হেপাটইিটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ও ডি ভাইরাস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস (ঐইঠ) এর আক্রমণে যকৃৎ (লিভার) আক্রান্ত হয়। সংক্রমণের প্রথম দিকে চোখ হলুদ হয়ে যায়, একে জন্ডিস বলে। জন্ডিস কোনো রোগ নয়, এটি রোগের লক্ষণ। এতে প্র¯্রাব হলুদ হয়। পেট ব্যাথা এবং সেই সাথে জ্বর হয়। ক্ষুধা মন্দা এবং বমি বমি ভাব হয়ে থাকে। মাংসপেশী এবং হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় অস্বস্তি অনুভব করে। গায়ের চামড়ার উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রভৃতি লক্ষণ দেয়া দেয়। লিভার আক্রান্ত হলে লিভারের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসে। তবে সংক্রমণের পর রোগের বড় কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৩০ থেকে ১৮০ দিন সময় লাগে। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস ‘বি’ তে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগেরই কোনো প্রাথমিক লক্ষণ থাকে না। ফলে ধীরে ধীরে ‘লিভার সিরোসিস’ এবং ‘লিভারের ক্যান্সার’ রূপ ধারণ করে। নারীদের তুলনায় পুরুষদের লিভার ক্যান্সারের প্রকোপ একটু বেশি।
লিভারে রক্ত চলাচল অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় বেশি, প্রতি মিনিটে প্রায় ১.৫ লিটার। অন্য কোনো ব্যক্তির রক্ত শরীরে চিকিৎসার জন্য গ্রহণ করতে হলে সঠিক পরীক্ষা করে নিতে হবে। বি ভাইরাস একবার শরীরে প্রবেশ করলে কখনোই আর শরীর থেকে বের হয় না। লিভার সিরোসিসের শেষ চিকিৎসা হচ্ছে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন বা লিভার প্রতিস্থাপন, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা সাধারণ কোনো পরিবারের পক্ষে কষ্টসাধ্য। আবার কেউ মনে করেন লিভার ক্যান্সার পরিবারের কারো থাকলে সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি, সে জন্য তাদেরকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। হেপাটাইটিস নির্মূল হোক বললেই এটা নির্মূল হয়ে যাবে না। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি’র বিস্তার হওয়ার পেছনে যে সব কারণ পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে- মা থেকে শিশুর মধ্যে সংক্রমণ, সংক্রামক সুঁই এবং সিরিঞ্জ ব্যবহার, সংক্রমিত বেøড, ক্ষুর, রেজার ও ব্রাশের ব্যবহার, সিঙ্গা বসানো, দাঁত, নাক ও কান ফোঁড়ানো যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন সার্জারি চিকিৎসায় আন-স্ট্রেরিয়ালাইজড বা অনিরাপদ যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছাড়াও অনিরাপদ যৌন ক্রিয়ার মাধ্যম উল্লেখযোগ্য।
এ রোগটিকে সাধারণভাবে দেখা ঠিক নয়। কেননা, ২০১৩ সালে বিশ্বে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ লোক মারা যায় লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। এদের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি লোক ক্রনিক হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রতি বছর লিভার আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ২৫ হাজারের অধিক মানুষ। আরেক বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত। আর তাদেরই বেশির ভাগই জীবনের কোনো কেনো পর্যায়ে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে আছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হেপাটইিটিস ‘বি’ এইডসের থেকেও ১০০ গুণ বেশি সংক্রামক। ১৯৮২ সাল থেকে টিকার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধের ইতিহাস রয়েছে। বি ভাইরাসে আক্রান্তদের ৯০-৯৫ শতাংশই নিরাময়যোগ্য। ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরুধঃরড়হ (ডঐঙ) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জন্মের প্রথম দিনেই এ রোগের টিকা নেয়া উচিত। হেপাটাইটিস-বি এর ভ্যাকসিন ডোজ ব্যক্তি বিশেষে ৩-৫টি। এই রোগ প্রতিরোধে প্রথম ৩টি একমাস পরপর এবং ৪র্থটি প্রথম ডোজের এক বছর পর। পাঁচ বছর পর বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হতে পারে। অথবা প্রথম ডোজ টিকা নেয়ার এক মাস পর দ্বিতীয়টি, প্রথম ডোজ নেয়ার দিন থেকে ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ নিতে হয়। এর পর পরীক্ষার পর নিশ্চিত হতে হয় যে টিকা নেয়ার পর পর্যাপ্ত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে না উঠলে পাঁচ বছর পর চতুর্থ ডোজ (বুস্টার) নিতে হয়। ভেকসিনের ভিন্নতার কারণে এ নিয়মের ব্যত্যয়ও ঘটতে পারে। জন্মের পর থেকে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত টিকা নেয়া যায় বলে জানা গেছে। টিকা নেয়ার আগে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে তার শরীরে ভাইরাসটি নেই্। এ ক্ষেত্রে নেগেটিভ হলেই তিনি টিকা নিতে পারবেন। প্রায় ৯৫% ক্ষেত্রেই এই টিকায় সফলতা আসে।
হেপাটাইটিস পজেটিভকে নেগেটিভ করে দেয়ার বিভ্রান্তমূলক অপপ্রচার। অনেক চিকিৎসক জন্ডিসের কবিরাজি চিকিৎসাকে কুপ্রথা বলে মনে করেন। একই সাথে জন্ডিস হলে ঠান্ডা পানি, আতিরিক্ত পানি পান, আখের রস, অতিরিক্ত ফলের রস পান করার রীতি চালু আছে। তাছাড়া হলুদ খাওয়া যাবে না ইত্যাদি বিধিনিষেধ দিয়ে থাকে যা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাছাড়া লিভার টনিক হিসেবে অনেক ধরনের ভেষজ (হারবাল) ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়, এগুলো তৈরির নিয়মকানুন, রোগীর শারিরীক অবস্থা, সেবনের সময় ও পদ্ধতি না জেনে পান করলে সুস্থতার পরিবর্তে অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে চিকিৎসকগণ তা গ্রহণ করতে নিষেধ করছেন।
সর্বোপরি বলতে চাই, ‘গোটা দেশের মানুষকে যাতে স্বল্প খরচে বি ভাইরাসের ভেকসিন সহজে পৌঁছে দেয়া যায় সেই ধরনের পরিকল্পনা নেয়া দরকার। বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেসব কারণে চিকিৎসার বাইরে আছে সেই সব বিষয় ভালোভাবে অনুসন্ধানপূর্বক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে যে সব কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে আন্তরিকতা থাকতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন