মেয়েটির বয়স বড় জোর আট, কি দশ। পলিথিনে মোড়ানো এক পোটলা শুকনো খাবার এক হাতে উঁচিয়ে ধরে আছে। হাবুডুবু অবস্থায় কোনো রকমে শ্বাস নেয়ার জন্য নিজেকে ভাসিয়ে রেখেছে। মুখে হাসি। এ হাসি আবার ঘিরে ধরেছে থৈ থৈ পানি। ছবিটি স্বাভাবিক সময়ে অত্যন্ত নান্দনিক হতে পারতো। অনির্বচনীয় সৌন্দর্য নিয়ে দর্শকের চোখে ধরা পড়তো। ফটোগ্রাফার সেরা পুরস্কারেও ভূষিত হতেন। তবে এই ছবি এখন আর আনন্দের নয়, বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টারত বন্যার্ত প্রতিটি মানুষের ছবি। মেয়েটি এখন কী অবস্থায় আছে, কেমন আছে, তা জানা সম্ভব নয়। শুধু কল্পনা করতে পারি, নাম না জানা এ মেয়েটি হয়তো হাজারো শিশুর মাঝে অনাহারে, অর্ধাহারে হয়ে আছে পানিবেষ্টিত কিংবা পানিতেই ভেসে আছে। প্রতিদিন বানভাসি মানুষের অসংখ্য অসহায় ছবি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। সব ছবিই করুণ। খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই, ওষুধ নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই। সর্বত্রই হাহাকার। যারা কোনো রকমে উঁচু জায়গা বা আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছে, তাদের দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই। কেউ উদাস হয়ে, গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বন্যার পর কী হবে এ চিন্তার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, এখন কীভাবে প্রাণে বেঁচে থাকা যায়। ত্রাণ কখন আসবে, এলেও ঠিকমতো পাবে কিনা, এ চিন্তায় ব্যাকুল। দেশের উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ বানভাসি মানুষ এমন দুঃসময় এবং দুঃস্বপ্নের মধ্যেই নিমগ্ন। সময় থেমে থাকে না, দুঃসময় কেটে সুসময় আসে। চিরন্তন এ কথা এখন বানভাসি মানুষের পক্ষে মানা সহজ নয়। কারণ তারা জানে, ভয়াবহ বন্যা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যে অকুল পাথারে ফেলে দিয়েছে, তা এ জীবনে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অর্জিত সব সম্পদই তো ভেসে গেছে। নতুন করে আবার তা অর্জন করবে কী করে?
দুই.
বন্যা শুরু হওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ঘোষণা দিয়েছিল, এবার বিগত ২০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়বে বাংলাদেশ। এ ঘোষণার এক-দুই দিন যেতে না যেতেই বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যমুনার পানি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে বিপদসীমার অনেক উপরে চলে যায়। পানির তোড়ে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যায়। জনমানবশূন্য বাড়ি-ঘরগুলো চাল পর্যন্ত ডুবে পরিত্যাক্ত হয়ে পড়েছে। যেদিকে দৃষ্টি যায়, কেবল পানির উত্তাল প্লাবন। কোমর পানি, গলা পানি অতিক্রম করে ঘরহারা মানুষ ছুটে চলেছে। কেউ গবাদি পশু কাঁধে নিয়ে বা নৌকায় করে ছুটেছে আশ্রয়ের সন্ধানে। মানুষ আর পশুতে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাইকেই বাঁচতে হবে। এমন এক অবর্ণনীয় চিত্র টিভি চ্যানেলসহ পত্র-পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত নারী ও শিশুরা। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন ঘোষণা দিয়েছে, বানভাসি মানুষের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ লাখ শিশু। শিশুদের বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দেয়ার জন্য সংস্থাটি সরকারের কাছে আহŸান জানিয়েছে। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ আহŸান জানাচ্ছে। যার যার এলাকার বন্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতির চিত্রও পরিসংখ্যানসহ তুলে ধরা হচ্ছে। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেউ কেউ গ্রæপ করে অর্থ ও ত্রাণ সহযোগিতার আহŸান জানাচ্ছেন। নগদ অর্থের জন্য বিকাশ নম্বরও দিচ্ছেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমসহ শো-বিজের তারকারাও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহŸান জানিয়েছেন। তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় যতদূর সম্ভব ত্রাণ সামগ্রী পাঠাচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে, বন্যা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, দুর্গত এলাকায় যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো এবং বিতরণ করা দুরুহ হয়ে পড়েছে। একমাত্র পথ হেলিকপ্টারে বা সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অত্যাধুনিক বোটে করে যদি ত্রাণ বিতরণ করা যায়, তবে দুর্গত ও দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। ত্রাণ দিতে ইচ্ছুক মানুষের পক্ষে এ পথে যাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র সরকারই পারে এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বন্যায় দেশে খাদ্য ঘাটতি হবে না। তার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। বিদেশ থেকে বেশি দামে হলেও চাল, গম আমদানি করা হচ্ছে। সরকারের এ ঘোষণায় মানুষ কতটা আশ্বস্থ হচ্ছে, তা বোঝা মুশকিল। কারণ ইতোমধ্যে বন্যা দুর্গত এলাকায় খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এমনিতেই বিগত কয়েক মাস ধরে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তার উপর বন্যায় এ দাম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষ এমনকি মধ্যবিত্তদেরও অধিক মূল্যে জিনিসপত্র কিনে জীবনযাপন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতির সহসা অবসান ঘটবে, এমন আশা করা যায় না। বন্যার ক্ষত দীর্ঘদিন ধরেই তাদের বইতে হবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনুমান করা যাচ্ছে, সামনের দিনগুলো মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। উত্তরাঞ্চলের বন্যার করাল গ্রাস দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশে বিস্তৃত হয়েছে। বলা যায়, পুরো বাংলাদেশ বন্যা কবলিত। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কতটা প্রস্তুত, তা আমরা জানি না। আবার তা সরকারের একার পক্ষেও মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এতে উচ্চবিত্তসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এ প্রচেষ্টা যদি না নেয়া হয়, তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা জীবন সংকটের মুখোমুখি হবে। কেউ কেউ আগাম বলছেন, দেশ যদি দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ আমরা এতদিন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যে কথা শুনে আসছি, তা এখন অসার প্রমাণিত হচ্ছে। বিদেশ থেকে চাল, গম আমদানি করে গুদাম ভরাতে হচ্ছে। বেশি দামে আমদানি করা খাদ্য দিয়ে ঘাটতি মেটানো খুবই কঠিন। এতে দাম যেমন কমানো যায় না, তেমনি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেও তা থাকে না। বন্যায় উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে যে ফসলহানি হয়েছে, তাতে বন্যা পরবর্তী সময়ে খাদ্য ঘাটতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, তা অনুমান করা সম্ভব নয়। সাধারণত বন্যাকালীন বিভিন্ন ত্রাণ ও সাহায্য-সহযোগিতার কারণে খাদ্য ঘাটতির বিষয়টি খুব একটা টের পাওয়া যায় না। সমস্যা দেখা দেয়, বন্যা পরবর্তী সময়ে যখন ত্রাণ সহায়তা থাকে না। মানুষ ভিটা-মাটিতে ফিরতে গিয়ে যখন দেখবে কিছুই নেই, তখন তাদের পরিস্থিতি আরও করুণ হয়ে পড়বে। একদিকে বসতভিটা পুনঃস্থাপন করা, অন্যদিকে ফসল ফলানোÑ এই দুইয়ের ধকল সামলানো তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। যারা ফসল ফলাতে পারবে না, তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠবে। যারা ফসল ফলাবে, ফসল ঘরে না উঠা পর্যন্ত তাদেরও একই দশায় কাটাতে হবে। অর্থাৎ এক বন্যা মানুষের সবকিছু যেমন ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি পরবর্তী সময়ে জীবনকে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
তিন.
সাধারণত যে কোনো প্রাকৃতিক দুযোর্গ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। সরকার বলে বিরোধী দল কিছুই করছে না, বিরোধী দলও বলে সরকার কিছু করছে না। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য লক্ষ করা যায়। এবারের বন্যায়ও এই পরস্পরবিরোধী রাজনীতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেছেন, বিএনপি ত্রাণ দেয়ার নামে ফটোসেশন করছে। বিএনপিও বলছে, বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, তারাও ত্রাণ দেয়ার নামে ফটোসেশন করছে। আবার ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ দেশে বন্যা আছে তা মানতেই নারাজ। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার গত সপ্তাহে শাহবাগে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে সরকার ব্যর্থ হয়েছে এমন বক্তব্য দিলে তার উপর ছাত্রলীগের একদল কর্মী চড়াও হয়। তারা হামলা চালিয়ে বলে, দেশে কোনো বন্যা নেই, বন্যা তোরা সৃষ্টি করেছিস। ইমরান তাতে দমে না গিয়ে পরদিন আবার শাহবাগে বক্তৃতা দিতে গেলে, আবারও হামলার শিকার হন। অর্থাৎ দেশে বন্যা আছে, ছাত্রলীগ তা মানতে নারাজ। এটা তাদের এক ধরনের স্ববিরোধী অবস্থান। কারণ দেশে যদি বন্যা নাই থাকতো, তবে সরকার ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিত না। প্রতিদিন টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় বন্যা এবং বানভাসি মানুষের করুণ চিত্র প্রকাশিত হতো না। উট পাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ঝড় নেই বলে উপেক্ষা করার মানসিকতা ছাত্রলীগের মতো একটি সংগঠনের কাছ থেকে আশা করা যায় না। বাস্তবতাকে অস্বীকার করার এ ধরনের প্রবণতা খুবই দুঃখজনক। দেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে, এটা স্বীকার করে নিয়ে প্রত্যেকেরই উচিত বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কোনো অজুহাত বা তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করা সমীচীন নয়। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম এবং বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে বন্যার পানি কমতে থাকায় সেখানে তার ভয়াবহ আঘাতের চিহ্ন ফুটে উঠছে। বন্যায় ৫০ লাখের উপর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসল ও সহায়-সম্পদের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনই নিরুপণ করা সম্ভব নয়। তবে বন্যায় যে অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে, তা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে, তাই এখন প্রধান বিষয়। এ নিয়ে রাজনীতি করা শোভন নয়। দেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রথমত সরকারের দায়িত্ব হলেও বিরোধী দলসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সংসদের বিরোধী দল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। রংপুরে এরশাদের নিজ এলাকার বানভাসি মানুষও হাহাকার করে বলছে, আমার এলাকার ছাওয়াল এরশাদ কোনঠে। এরশাদ এলাও আইল না কেনে বাহে? বন্যার্ত মানুষের এ আহাজারি সংসদের বিরোধী দল যে শুনছে না, তা তার নীরবতা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। মানুষ মহা মুসিবতে আছে, অথচ তাদের পাশে জাতীয় পার্টির কেউ নেই। বিপন্ন মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকা জনবিচ্ছিন্ন এমন বিরোধী দল বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। তার রাজনীতির ভিত্তি কি, এ প্রশ্ন এখন মানুষ করতেই পারে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নিয়েও পরস্পর বিরোধী রাজনীতি হতে আমরা দেখছি। অথচ এ সময় রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোই কাম্য। বিরোধী দলগুলো যদি পাশে দাঁড়ায়, তবে ক্ষমতাসীন দলের উচিত তাদের স্বাগত জানানো। আমরা দেখছি, ক্ষমতাসীন দল এ কাজ না করে উল্টো সমালোচনা করছে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, কুড়িগ্রামসহ অন্যান্য বন্যাদুর্গত এলাকায় তাদের ত্রাণ বিতরণে সরকারি দল বাধা দিচ্ছে। এটা কেমন কথা? দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো নিয়ে এ কোন ধরনের রাজনীতি? ক্ষমতাসীন দলের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, পারুক না পারুক বন্যার্তদের পাশে তারা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল দাঁড়াতে পারবে না। তারা একাই পাশে দাঁড়াবে। অথচ অহরহ অভিযোগ উঠছে, দুর্গম এলাকাসহ অনেক এলাকার অসংখ্য মানুষ সরকারি ত্রাণ পাচ্ছে না। অব্যবস্থাপনা, উদ্যোগের অভাবসহ যে কারণেই হোক সরকার যে একা পুরো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, তা পরিষ্কার। এক্ষেত্রে বিরোধী দল যদি এগিয়ে আসে, তাতে ক্ষতি কি! বন্যার্তদের সাহায্য করা নিয়েও কি পরস্পর বিরোধী রাজনীতি করতে হবে?
চার.
রাজনীতির মূল লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ। যে মানুষ নিয়ে রাজনীতি, সেই মানুষই যদি অসহায় হয়ে পড়ে, তবে রাজনীতির কোনো অর্থ হয় না। বন্যায় যে শুধু বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নয়। এর প্রভাব সারাদেশের মানুষের উপরই পড়ছে। ক্ষতির রেশ সবাইকেই বহন করতে হবে। ইতোমধ্যে যে ৬ লাখ ১৮ হাজার ৭০৯ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট, ২৮০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বন্যার্ত মানুষ নিঃস্ব হয়েছে, এর সুদূর প্রসারী ক্ষতি পোষাণো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর ও কুড়িগ্রামে বন্যার্ত মানুষের সমাবেশে ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন ফসল ঘরে না উঠা পর্যন্ত বন্যা পরবর্তী তিন মাস খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। পাশাপাশি ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা বন্যার্তদের মাঝে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে। তবে এ কর্মসূচি দ্রæত বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। কয়েক মাস আগে হাওরে অকাল বন্যায় ফসল ভেসে যাওয়ার কারণে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়। বন্যায় সারাদেশে যে ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তাতে যে আগামী দিনে খাদ্য সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠবে এবং খাদ্য আমদানি করতে হবে তাতে সন্দেহ নেই। এর অনিবার্য ফলাফল স্বরূপ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও হু হু করে বাড়তে থাকবে। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ টানাপড়েন দেখা দেবে। এ পরিস্থিতিও সরকারকে সামাল দিতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দেশে যে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে তা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পূর্বাভাস দিয়েছে। বিশ্বের যে কটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ শিকার হবে, বাংলাদেশ তার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি আশানুরূপ নয়। বন্যা মোকাবেলায় বছরের পর বছর ধরে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে নির্মাণ করা হয়নি। এবারের বন্যায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেশে ১৯০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ৬০০ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ বন্যায় ভেসে গেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় খোদ সরকার দলীয় এমপিরা অভিযোগ করেছেন, বন্যার আগে অর্থাৎ গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারাদেশের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো সঠিকভাবে মেরামত করা হয়নি। এ কারণে বন্যায় একের পর এক বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এছাড়া বাঁধের উপর অবৈধ বাড়িঘর ও স্থাপনাও এই ক্ষতির জন্য দায়ী। বলা বাহুল্য, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ যথাযথভাবে নির্মিত না হওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। এ খাতে বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও সেগুলোর অধিকাংশই দুর্বল থেকে যায়। বন্যা শুরু হলে সেগুলো বালির বাঁধে পরিণত হয়। যেসব এলাকায় বন্যার পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙ্গে গেছে, সেগুলো যদি পোক্তভাবে তৈরি করা হতো, তাহলে অনেক এলাকা বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেত। একদিকে দুর্বল বন্যা প্রতিরোধক ব্যবস্থা, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশের বৈরী আচরণ দেশকে ভয়াবহ বন্যার শিকারে পরিণত করছে। এবারের বন্যার মূল কারণই ছিল, ভারত কর্তৃক তিস্তা ও ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়া। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের যে বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা ভারতের বিরোধিতার কারণে আটকে আছে। এই গঙ্গা ব্যারেজ নির্মিত হলে দেশের বন্যা পরিস্থিতি যেমন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ হওয়া যেত। আমরা মনে করি, গঙ্গা ব্যারেজটি নির্মাণে সরকারের দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো যথাযথভাবে সংস্কার করা জরুরি। এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো। বন্যার পানি নেমে যাওয়া থেকে শুরু করে বন্যা পরবর্তী সময়ে যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, এ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষকদের সহায়তা প্রদান, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, সুদমুক্ত ঋণ দান কর্মসূচি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ উদ্যোগ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন