রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

কোরবানির দেখা আঙ্গিক এবং অদেখা আঙ্গিক

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পবিত্র ঈদুল আজহা সারাবিশ্বে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ও ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এদিনে সবচেয়ে প্রিয়বস্তুকে কোরবানি করার অবিস্মরণীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে আল্লাহর নির্দেশে প্রাণপ্রিয় সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.)কে মিনা প্রান্তরে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে শিশুপুত্রের পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। আল্লাহর নবী ঈমানের চরম অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর ঐতিহাসিক ও বিস্ময়কর ত্যাগের কারণে পৃথিবীতে মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রবর্তিত হয় আত্মোৎসর্গের মহাপুরস্কার পরম আনন্দ ও চরম খুশির দিন পবিত্র ঈদুল আজহা বা ‘কোরবানির ঈদ’। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পশু কোরবানির রেওয়াজ। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো।’
কোরবানির কথা বলতে গেলেই নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর কথা বলতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে বহু সংখ্যক নবী পাঠিয়েছেন। যে সকল নবীর নাম পবিত্র কোরআন শরীফে উল্লেখ আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর নাম। খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে ২০১৭ চলছে। খ্রিস্টপূর্ব কত সালে ইব্রাহিম (আ.) এই জগতে ছিলেন এবং কত বছর ছিলেন সেটা গবেষণার বিষয়। প্রকাশিত অনেক বই আছে যেগুলোতে নবীগণের জীবনী যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা আছে। জীবনী লেখার জন্য প্রধান ভিত্তি হচ্ছে পবিত্র কোরআনে নবীগণ সম্বন্ধে বর্ণনা এবং পবিত্র হাদিসে নবীগণ সম্পর্কে উল্লেখ। আমার নিজের সংগ্রহে যে কয়েকটি বই আছে তারমধ্যে একটির নাম হচ্ছে ‘এটলাস অফ দি কোরআন।’ বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়াবে, কোরানের মানচিত্র। সহজ ভাষায় বললে দাঁড়াবে, পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত নবীগণের এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে বর্ণিত স্থানগুলোর এবং তাঁদের চলাচলের পথগুলোর বর্ণনা। দুই-চারটি উদাহরণ দিচ্ছি। হযরত আদম (আ.) এর নাম বা প্রসঙ্গ পবিত্র কোরআনে ২৫টি আয়াতে মোট ২৫ বার এসেছে। হযরত ইদ্রিস (আ.) এর নাম পবিত্র কোরআনে মাত্র ২ বার উল্লেখিত হয়েছে। হযরত নূহ (আ.) এর নাম পবিত্র কোরআনে ৪৩ বার উল্লেখিত হয়েছে। অনুরূপভাবে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর নাম পবিত্র কোরআনের ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন সুরায় ৬৯ বার উল্লেখিত হয়েছে। এই এটলাসটি মোতাবেক, হযরত ইব্রাহিম (আ.) আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ বছরের আগে-পরে পৃথিবীতে ছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব বছর ১৮০০ বা অন্য যে সময়েই হোক না কেন, ইব্রাহিম (আ.) যে ছিলেন, সেটা ঐতিহাসিকভাবে সর্বসম্মত একটি তথ্য। মুসলমানদের জন্য এটা অলংঘনীয় তথ্য এবং বিশ্বাস। তাঁর দুই পুত্র ইসমাইল (আ.) এবং ইসহাক (আ.) উভয়েই নবী ছিলেন। ইব্রাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) এর মধ্যে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল সেটি পবিত্র কোরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখিত আছে। এই ঘটনা সচেতন মুসলমানগণ জানেন এবং সচেতন খ্রিস্টানগণও জানেন। স্বপ্নে প্রদত্ত আল্লাহ তায়ালার হুকুম মোতাবেক, মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন। আল্লাহতায়ালার হুকুমে এবং বন্দোবস্তে, সর্বশেষ মুহূর্তে, ইসমাইল (আ.)এর বদলে একটি দুম্বা কোরবানি হয়। ইব্রাহিম (আ.) এর ত্যাগের মানসিকতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দৃঢ় সংকল্প মহান আল্লাহতায়ালাকে ভীষনভাবে মুগ্ধ করে। এই ঘটনাটিকে মহান আল্লাহতায়ালা মিল্লাতে ইব্রাহিমের জন্য ইবাদতের অংশ করে দেন। সেই থেকে আমরা মুসলমানগণ জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপন করি। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর মর্যাদা এতই উঁচু যে, নামাজের মধ্যে যেই দরূদ শরীফ পড়া হয়, সেই দরূদ শরীফেও ইব্রাহিম (আ.) এর নাম, আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) এর নামের পরপরই উল্লিখিত আছে।
পবিত্র ঈদুল আযহায় মূল অভিব্যক্তি হলো, ত্যাগ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অনেক বেশি কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা নেই। মহান আল্লাহতায়ালাই আমাদের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের লালন-পালনকর্তা, আমাদের প্রতিপালনকারী, আমাদের রিজিক ও সম্মান প্রদানকারী। অতএব, আমরা যার উপর সর্বোতভাবে নির্ভরশীল তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের কর্মটি প্রয়োজনীয় হবে এটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। বরং আলোচ্য বিষয় হতে পারে ঐ সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, আমরা কে কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করবো বা কষ্ট করবো। এই চেষ্টার অংশ হিসেবেই আল্লাহ তায়ালা একটি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া দিয়েছেন। সেটি হলো, এই কোরবানি। পশুর রক্ত বা মাংস মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে পৌঁছাবে না, এবং আল্লাহ তায়ালা সেই পশুর রক্ত বা মাংসের জন্য অপেক্ষাও করেন না। যেটি আল্লাহ তায়ালার কাছে পৌঁছাবে এবং যার জন্য আল্লাহ তায়ালা অপেক্ষা করবেন, সেটি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভালোবাসা এবং সন্তুষ্টি অর্জনের স্পৃহা।
মনে করুন, এক লক্ষ টাকা দিয়ে একটি গরু কেনা গেল। এক লক্ষ টাকা দিয়ে গরু কেনার উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষকে এইরূপ দেখানো যে, অনেক দামি একটা কোরবানি দিলাম, যেন মানুষ সেটা দেখে অভিভূত হতে পারে। কিন্তু তাতে মহান আল্লাহতায়ালা অভিভূত বা সন্তুষ্ট না হওয়ারই সম্ভাবনা। মহান আল্লাহ তায়ালা চান আমার বা আপনার কষ্টার্জিত সম্পদ থেকে কিছু অংশ ব্যয় করে আমি একটি পশু ক্রয় করি এবং সেটি আল্লাহর রাস্তার কোরবানি দিই। আল্লাহর নিকট এটাই গ্রহণযোগ্য যে, আমার সম্পদ থেকে আমি কতটুকু ব্যয় করলাম এবং সেখানে কোনো লোক দেখানো মনোভাব ছিল না। কোরবানির পশুর মাংস কোরবানি দাতার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীগণ একটি সুন্দর বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভোগ করতে পারেন। এর মাধ্যমে সামাজিক সহমর্মীতা বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
মানুষের মনে যেন ত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি হয় তার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা বারবার তাগাদা দিয়েছেন। সকল ধর্ম প্রচারকগণ এই মর্মে তাদের অনুসারীদের নিকট তাগাদা দিয়েছেন। বিভিন্ন কর্মযজ্ঞের মাধ্যমেও এইরূপ ত্যাগের স্পৃহা সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়। ‘ত্যাগের স্পৃহা’ এটি আমার কলামের পরবর্তী অংশের উপজীব্য। বিদ্যমান পূঁজিবাদী, ভোগবাদী অর্থনীতি এবং দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ত্যাগ নামক স্পৃহাকে উৎসাহিত করে না। আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে, সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যেন মানুষের মনে ত্যাগের স্পৃহা সৃষ্টি হয়। মনে করুন, সরকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাবির মুখে ৭.৫% ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিল। এটা সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রদের জন্য একটি ত্যাগ।
ত্যাগের সামাজিক উদাহরণ দিচ্ছি। আজকাল সামাজিক দায়িত্ব পালন তথা কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সংক্ষেপে সিএসআর) নামক বাক্যাংশ মিডিয়ার কারণে সুপরিচিত। মনে করুন, একটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বা শিল্প গোষ্ঠী যার নাম ‘মরুভূমি গ্রæপ’, তারা সিএসআর কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একটি দূরবর্তী গ্রামে একটি ভগ্নপ্রায় প্রাইমারি স্কুলের বিল্ডিংটিকে নতুন বানিয়ে দিল। এটা হলো বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, ঐ গ্রামের জনগণের জন্য মরুভূমি গ্রæপের পক্ষ থেকে ত্যাগ স্বীকার। মনে করুন, ‘শ্রী সাহস নারায়ণ তালুকদার’ নামক একজন ব্যক্তি তার জন্মস্থান গ্রামে মন্দিরের পাশে একটি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করে দিল, যাতে করে গ্রামবাসী আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি পায়। এটা হলো গ্রামবাসীর জন্য তার পক্ষ থেকে একটি ত্যাগ স্বীকার। মনে করুন, জনৈক ধনী ব্যক্তি ‘জনাব সাগরেদ আলী চৌধুরী’ তার গ্রামে একটি মাদরাসা স্থাপনের জন্য এবং এটার পাশাপাশি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের জন্য ছয় শতাংশ জমি ওয়াকফ করে দিলেন। এইটি হলো জনাব ওস্তাদ আলীর পক্ষ থেকে নিজের গ্রাম ও চতুর্পাশ্বের জনপদের মানুষের শিক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার। আরেকটি সাংসারিক উদাহরণ দেই। বহুক্ষেত্রেই সংসারে অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততি রেখে পিতা মারা যান। তখন ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার দায়-দায়িত্ব সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই তার নিজের কাঁধে তুলে নেয়। এই সূত্রেই মনে করুন, পাঁচটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে সন্তান রেখে কোনো একটি সংসারের পিতা ‘জনাব কালু মিয়া’ মারা গেলেন। সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তানের বয়স ১৮ বছর; সবেমাত্র এইচএসসি পাশ করেছে। সেই ১৮ বছর বয়স্ক সন্তান শুধুমাত্র নিজের লেখাপড়ার খরচ মিটানোর জন্য চাকরি করতে পারতো, কিন্তু সেই ১৮ বছর বয়স্ক সন্তান, ছোট ভাইদেরকেও পড়ানোর দায়িত্ব নেয়। ছোট বোন থাকলে, বোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেয়। এটা হলো বড় ছেলের পক্ষ থেকে পরিবারের জন্য ত্যাগ স্বীকার।
ঈদুল আযহার দিনে একটা মানসিক কর্ম বা সরেজমিন কর্ম হলো টাকা খরচ করে, গরু বা ছাগল কিনে কোরবানি দেওয়া তথা ত্যাগ স্বীকার করা। এবং অন্য যে কর্মটি সম্পাদন করা উচিত সেটা হলো, নিজেদের মনের ভেতরের পশুত্বকে চিহ্নিত করা বা আবিষ্কার করা এবং সেই পশুত্বকে দমন করা। এই প্রক্রিয়া যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে আমার মনের ভেতরে ত্যাগ স্বীকার করার প্রবণতাকে সুদীপ্ত ও প্রখর করতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। আমার মূল্যায়নে বর্তমান সমাজে খুব কম লোকই এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন, অতএব খুব কম লোকই আন্তরিক ত্যাগ স্বীকারে অধিকতর আগ্রহী হন। অন্য একটি কথা হলো, প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার ফলে হয়তো বা নিজের পশুত্বকে তো দমন করতে পারলামই না, ত্যাগ স্বীকারের মনোবভাবকে প্রখর করতে পারলামই না, বরং একটা উল্টো কাজ করলাম। সেই উল্টো কাজটি হলো, আমি অনেক লোককে দেখাতে চাইলাম আমার কত টাকা আছে, আমি কতবড় গরু কোরবানি দিচ্ছি তোমরা দ্যাখো! অর্থাৎ লোক দেখানো কোরবানি এবং অহংকারে বিদ্ধ হলাম।
কোরবানি মুসলিম মিল্লাতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। তাই বিশ্ব মুসলিম অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত হিসাবে এই মহিমান্বিত দিনটিকে পবিত্র ঈদুল আজহা হিসেবে পালন করে আসছে। কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে ত্যাগ ও কোরবানির মাধ্যমে সমাজ থেকে সকল অন্যায়, অনাচার, পাপ-পঙ্কিলতা, ইন্দ্রীয় পরায়ণতা, জুলুম-নির্যাতনসহ সকল প্রকার অনৈতিক ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ ও প্রতিহতের মাধ্যমে সমাজে সার্বিক শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। তাই ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণ করে সমাজে প্রতারণাতন্ত্র, জুলুমতন্ত্র ও অহংকারতন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে।
ঈদুল আজহার ত্যাগ ও কোরবানির মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য ও অপার সন্তুষ্টি লাভ করা। কোরবানির লক্ষ্যই হলো নিজের নফস্ বা আত্মা তথা আমিত্বকে আল্লাহর রাহে সমর্পণ করা এবং নিজের প্রিয়বস্তু বা ধন-সম্পদকে আল্লাহর নামে বিলিয়ে দেয়া বা উৎসর্গ করা। গৃহপালিত গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা প্রভৃতি চতুষ্পদ জন্তুর যে কোনো একটি দিয়ে কোরবানি দেয়া যায়। মুসলমানেরা আল্লাহর কাছে যেমনভাবে আত্মসমর্পণ করেন, তা হলো যখন পশু কোরবানি করা হয় তখন পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটি স্মরণ করা হয়, ‘ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ্ইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৬২)
আল্লাহর কাছে কখনো কোরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি পৌঁছায় না, শুধু পৌঁছায় আন্তরিকতা ও খোদাভীতি। কোরবানিকৃত পশুতে মানুষের জন্য অশেষ কল্যাণ নিহিত; যার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। মুমিন বান্দার প্রিয়বস্তু ত্যাগের মানসিকতা, হৃদয়ের পবিত্রতা, মনের স্বচ্ছতা, মহানুভবতা, আবেগ-অনুভূতি ও তাকওয়ার চিহ্নস্বরূপ আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদের ব্যয়কে তিনি পছন্দ করেন। কে কত বড় মোটা-তাজা পশু আল্লাহর নামে কোরবানি বা উৎসর্গ করলো এবং কত বেশি টাকা দামে ক্রয় করলো তা তিনি দেখেন না; বরং তিনি দেখেন তাঁর বান্দার মনের অবস্থা। মানুষ কী লোক দেখানোর জন্যে কোরবানি করলো, না কী সত্যি সত্যি আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় করলো তা-ই তিনি দেখেন এবং সেই অনুপাতে আল্লাহ তার উৎসর্গীত পশুকে কবুল করে থাকেন। যারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ও নেকি পাওয়ার উদ্দেশ্যে হালাল অর্থে ক্রয়কৃত জন্তু-জানোয়ার কোরবানি করেন তাদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের গোশ্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো।’ (সূরা আল-হজ্জ, আয়াত: ৩৭)
ঈদুল আজহার দিনে পশু কোরবানি করাই সর্বোত্তম ইবাদত। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে পশুপ্রবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি দু’টোই বিদ্যমান। পশুপ্রবৃত্তিকে সংযত রেখে বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগে মানুষ যখন নিজের জীবনকে সঠিক, সুন্দর ও ন্যায়নীতির পথে পরিচালিত করে, তখন একে আদর্শ জীবন বলা হয়। এটি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে অনেক ঐকান্তিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। নিজের সর্বস্ব ত্যাগ, উৎসর্গ বা কোরবান হচ্ছে মনের পশুপ্রবৃত্তিরই বিসর্জন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সবসময় কোরবানি করেছেন এবং সামর্থ্যবান মুসলমানদের কোরবানি করতে উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেছেন, ‘কোরবানির দিন মানব সন্তানের কোনো নেকআমলই আল্লাহর কাছে ততো প্রিয় নয় যতো প্রিয় রক্ত প্রবাহিত করা বা কোরবানি করা। কোরবানির পশু ও তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ কিয়ামতের দিন এনে দেয়া হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো।’ (তিরমিযি ও ইবনে মাজা) বস্তুত ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি ত্যাগের প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্র। সারাবিশ্বের মুসলমানদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, ¯্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ ও আত্মোপলব্ধির শিক্ষা ঈদুল আজহার চেতনায় আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব সর্বোপরি প্রিয়বস্তুকে কোরবানি দেয়ার সুদৃঢ় প্রত্যয়ের মধ্যে নিহিত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে কোরবানির ঈদ আত্মশুদ্ধি ও আত্মত্যাগের নামান্তর। আমরা যেন কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা বুঝতে উপলব্ধি করতে সক্ষম হই।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন