শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

গুম: মানবাধিকারের লংঘন

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গুমের ইংরেজি প্রতি শব্দ হলো উরংধঢ়ঢ়বধৎ। কোনো ব্যক্তি উরংধঢ়ঢ়বধৎ হয়ে যাওয়ার অর্থ হলো উক্ত ব্যক্তিকে জীবিত বা মৃত না পাওয়া। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে না পাওয়ার অর্থই হচ্ছে গুম। গুম বা উরংধঢ়ঢ়বধৎ সাধারণত তিন ধরনের হতে পারে। প্রথমত, কোনো ব্যক্তি নিজে স্বেচ্ছায় গুম বা উধাও হয়ে যান। দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি দুর্ঘটনাবশত গুম বা উধাও হন এবং তৃতীয়ত, কোনো ব্যক্তিকে জোরপূর্বক গুম বা উধাও করা হয়। বিশ্বে গুমের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, বহু প্রাচীন যুগ হতে এই গুমের ঘটনা ঘটে আসছে। বিশেষত প্রাচীন যুগে যুদ্ধে পরাজিত হবার পর পরাজিত দলের নেতা গুম হয়ে যেতেন। এই ধরনের গুমে পরাজিত দলের নেতা হয় নিজে উধাও হয়ে যেতেন কিম্বা তাকে মেরে ফেলা হতো। ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে রোমান স¤্রাট ভ্যালেন ইধঃঃষব ড়ভ অফৎরধহড়ঢ়ষব-এর যুদ্ধে পরাজিত হবার পর গুম বা উধাও হয়ে যান। হয় তিনি নিজে পরাজিত হয়ে উধাও হন অথবা তাকে হত্যা করা হয়। তাকে আর কখনও দেখা যায়নি বা তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ ইবনে কাশেম অননধংরফ খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে পরাজিত ও বন্দী হন। এই বন্দী অবস্থা থেকে পলায়ন করার পর মোহাম্মদ ইবনে কাশেমকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১২০৩ সালে ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উত্তারাধিকার প্রথম আর্থার গুম বা উধাও হন। ১৪৮৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের পুত্র পঞ্চম এডওয়ার্ড গুম হন। মনে করা হয়, তার চাচা তৃতীয় রিচার্ড তাকে গুম করেন। অপরাধ বিষয়ক বিখ্যাত লেখক আগাথা ক্রিস্টি ১৯২৬ সালে গুম বা উধাও হন। অবশ্য কিছুদিন পরে তিনি আবির্ভূত হন। তার এই সাময়িক গুম হয়ে যাওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের অনেক গুমের ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে জোরপূর্বক গুম একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক এ ধরনের গুমের ঘটনা এখন প্রায় অকল্পনীয়।
নতুন কিছু আবিষ্কার করতে গিয়ে বহু উদ্ঘাটনকারী গুম বা উধাও হয়েছেন। বিশেষ করে এই পৃথিবীর রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বহু নাবিক ও বৈজ্ঞানিক উধাও হয়ে গেছেন। অবশ্য এই সমস্ত উধাও দুর্ঘটনাবশত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই গুমের ব্যবহার রাজনৈতিকভাবে শুরু হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফ্যাসিস্ট ও একনায়কতান্ত্রিক শাসকগণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বীদের ধ্বংস করার জন্য এই গুম শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নাজি জার্মানির হিটলার তার এবংঃধঢ়ড় বাহিনী এবং গোপন পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে বহু গুমের ঘটনা ঘটিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে গুমের ঘটনা শুরু হয় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এই সমস্ত উন্নয়নশীল দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসকগণ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে গুম শুরু করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসক জেনারেল জর্জ রাফেল ভিডেলা ত্রিশ হাজার ব্যক্তিকে গুম করেন। এই গুম করার কাজে ব্যবহার করা হয় সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট গোপন পুলিশ বাহিনীকে।
১৯৭৩ সালে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে অগাস্ট পিনোচেট রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বহু মানুষকে গুম করেন। এক হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, পিনোচেটের শাসনামলে ২২৭৯ জন গুম হয়। কলোম্বিয়ায় ২০১৬ সালের এক হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, আধাসামরিক বাহিনী ও গেরিলা গ্রæপের মাধ্যমে ৩০০০০ ব্যক্তি গুম হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকার বাইরে গুমের ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দেশে।
গুমের সাথে জড়িত শাসকদের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। আর্জেন্টিনার জর্জ ভিডেলাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে এবং তাকে কারাবাস করতে হচ্ছে। চিলির পিনোচেটকেও সম্মুখীন হতে হয়েছে বিচারের। এমনকি তাকে হত্যা করার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল একটি বাহিনী। গুমের মাধ্যমে ক্ষমতায় যারা টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন, তারা কেউই ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি এবং নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। গুমের ঘটনার প্রতিবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি হয়েছে সশস্ত্র প্রতিপক্ষ। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় আলজেরিয়া, গুয়াতেমালা, কলোম্বিয়া প্রভৃতি দেশের কথা। এছাড়াও সেসব দেশের জনগণ এই গুমকে সহজভাবে গ্রহণ করতে না পারায় ফুঁসে উঠেছে এবং অবসান ঘটিয়েছে স্বৈরশাসকদের।
সম্প্রতি এই উপাদান যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তবে এটা যে একেবারেই নতুন উপাদান তা নয়। অতীতে বাংলাদেশে গুমের ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতার পরপর গুম হন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান। স্বাধীনতার পর আরো অনেকের গুম হওয়ার কথা শোনা যায়। ১৯৭৫-এ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাম্প্রতিককালে এই বিষয়টি তীব্র আকার ধারণ করেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বর্তমানে গুমের সাথে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিছুদিন পূর্বে মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মন্তব্য করেছেন যে, অনেক গুমের সাথেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তার এই বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, গুমের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের সমপৃক্ততা রয়েছে। যদিও সরকার বিষয়টিকে অস্বীকার করছে। এখন প্রশ্ন হলো যে, কেন সরকার এই গুম বন্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? তবে কি গুমের সাথে জড়িত গোষ্ঠী সরকারের চাইতেও ক্ষমতাশালী? যদি তাই হয়, তবে এটা সরকারের জন্যও বিপজ্জনক। বর্তমানে যারা সরকার পরিচালনা করছেন তাদের মনে রাখা উচিত, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। বর্তমানে সরকার পরিচালনাকারীগণ যখন ক্ষমতার বাইরে থাকবেন তখন তারাও যে এই গুমের শিকার হবেন না তার নিশ্চয়তা কি দেয়া যায়? কাজেই সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে এই বিষয়টি বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
গুম আন্তর্জাতিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ২০০২ সালে জড়সব ঝঃধঃঁঃব ড়ভ ঃযব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈৎরসরহধষ ঈড়ঁৎঃ গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৬ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ গুমের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়হাবহঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব চৎড়ঃবপঃরড়হ ড়ভ অষষ চবৎংড়হং ভৎড়স ঊহভড়ৎপবফ উরংধঢ়ঢ়বধৎধহপব নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালা অনুসারে গুম মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং এই অপরাধ শাস্তিযোগ্য।
বাংলাদেশে ঘটতে থাকা গুমের ঘটনাও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে গণ্য। এই মানবতাবিরোধী অপরাধ যাতে আর সংঘটিত হতে না পারে, তার জন্য সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। না করলে ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন