মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
অসভ্যতা, পাশবিকতা ও বিকৃতির এক ভয়ানক চিত্র দেখা যাচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। ছোট ছোট বাড়িগুলো ভেঙে ১০ তলা ও ২০ তলা উঁচু দালান হয়তো তৈরি হচ্ছে, কিন্তু মানুষের মন দিন দিন নিচের দিকে যাচ্ছে। মনুষত্ব ও মূল্যবোধের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটছে। দেশে শিশু হত্যা ও ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। গত দুই মাসে প্রায় ৫০টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে দেশে। গেল বছর সিলেটে রাজন ও খুলনায় রাকিব হত্যার মধ্য দিয়ে শিশু হত্যার যে পৈশাচিক ধারা শুরু হয়েছে, তা ক্রমেই ভয়াবহরূপ নিচ্ছে। বনশ্রীতে দুই ও হবীগঞ্জে ৪ শিশু হত্যার ঘটনা ভয়াবহতার সীমা অতিক্রম করে আবেগ ও ভালোবাসার মৃত্যু ঘটিয়েছে। ঢাকার বনশ্রীতে দুই শিশু হত্যার অভিযোগ স্নেহময়ী মায়ের দিকে। অন্যদিকে ঘটছে শিশু ধর্ষণের ঘটনাও। ৫ বছরের শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে মধ্যবয়সী পুরুষের হাতে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে, প্রায় এক ডজন শিশু ধর্ষিত হয়েছে মানুষ নামের জানোয়ারদের হাতে; এ ধর্ষণ থেকে বাদ যাচ্ছেন না মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাও। একটি পাঁচ বছরের মেয়ের শরীরে কী এমন রূপ ও সৌন্দর্য আছে, যা দেখে একজন পুরুষের উত্তেজনা তৈরি হতে পারে? এরা তো ওই শিশুদের ধর্ষণ করছে না, ধর্ষণ করছে পুরো মানবজাতিকে; ধর্ষণ করছে মনুষ্যত্বকে।
যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন এবং ডিভোর্স অসম্ভবরকম বেড়ে যাচ্ছে সমাজে। তিলে তিলে গড়ে তোলা সোনার সংসার মুহূর্তেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। সবচে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা পরিবারের ভেতরই সংসদ্যরা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছে। বাংলাদেশে আজ স্বামীর কাছে স্ত্রী নিরাপদ নয়, স্ত্রীর কাছেও নিরাপদ নয় স্বামী। নিরাপদ নয় মায়ের কাছে সন্তান এবং সন্তানের কাছে মা। এমনকি শিক্ষকের কাছেও নিরাপদ নয় শিক্ষার্থী। অপরূপা রূপসীরাও তাদের ভালোবাসার স্বামীদের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন। নয়ন জুড়ানো, প্রাণ ভরানোর মত আদরের সন্তানকেও তার আপন মমতাময়ী মায়ের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে, যা মনুষ্যত্বকে রীতিমত স্তম্ভিত ও হতবাক করছে; নিজ পরিবারের ভেতর যদি মানুষের নিরাপত্তা না থাকে তাহলে সমাজে আলোকিত বা ভালো মানুষ কীভাবে তৈরি হবে?
গত কয়েক দিনে দেশে শিশু ধর্ষণের বীভৎস ও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে সালমা আক্তার নামে এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। রাজবাড়িতে এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে এক পাষ-। মাদারিপুরে এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরায় কয়েক যুবক মিলে এক শিশুকে গণধর্ষণ করেছে। ফরিদপুরে ধর্ষিত হয়েছে এক শিশু। নীলফামারিতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক শিশু। নাটোরে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের শিশু মেয়েকে তার স্কুল থেকেই ধরে নিয়ে গেছে এক বখাটে যুবক। ঢাকার মিরপুরে বেড়ি বাঁধের ওপর এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পটুয়াখালীর দশমিনায় ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছে। মৌলভী বাজারের কুলাউড়ায় এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক করা হয়েছে ধর্ষককে।
যশোরের কেশবপুরে দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছে ধর্ষক। ঢাকার মিরপুরে এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ঢাকার তোপখানা রোডে ১০ বছরের এক শিশুকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ বাথরুমে তালা বদ্ধ করে রাখা হয়। রংপুরে ৬ বছরের এক শিশু ধর্ষিত হয়েছে এক মধ্যবয়সী বীর পুরুষের হাতে। গোপালগঞ্জে এক শিশুর শ্লীলতাহানি করেছেন ৫৫ বছরের মানুষ নামের এক জানোয়ার। কুষ্টিয়ায় এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নোয়াখালিতেও ধর্ষিত হয়েছে এক শিশু। হবিগঞ্জ, মাধারীপুর, গাইবান্ধা, চাঁদপুর ও সিরাজগঞ্জে পৃথকভাবে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
তা ছাড়া টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক কিশোরী। চট্টগ্রামের খুলশীতে কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এক কর্মজীবী মহিলাকে চারজন মুখ বেঁধে ধর্ষণ করে। হবিগঞ্জের মাধবপুরে এক গামেন্টস শ্রমিককে গণধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। মিঠপুকুরে এক কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণের পর ভিডিও চিত্র ধারণ করে রাখে কতিপয় বখাটে যুবক। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গামেন্টকর্মী দু’বোনকে চোখ-মুখ বেঁধে ১০-১২ জন মিলে গণধর্ষণ করে। উল্লাপাড়ায় এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলন্তবাসে এক গামেন্টকর্মীকে ধর্ষণ করেছে বাসের চালক ও হেলপার। পিরোজপুরের কাউখালিতে কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে জামির নামে এক লম্পট। তাছাড়া গাজীপুরে এমপির এপিএস কর্তৃক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে এক কিশোরী। ঢাকার উত্তরায় এক গৃহকর্মীকে ধর্ষণের হত্যা করা হয়। সূত্র বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল। লক্ষণীয় মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদেরও নৈতিক অধঃপতন ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। একজন শিক্ষকের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ আর কে গ্রহণ করে? অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে গড়ে তুলতে যে, অপরিসীম জীবনী শক্তি লাগে তা তো কেবল একজন শিক্ষকেরই থাকে। সে শিক্ষক কীভাবে পারেন ছাত্রীকে ধর্ষণ করতে? কীভাবে ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সর্ম্পক গড়ে তুলেন?
ধর্ষণের অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপককে আটক করেছে পুলিশ। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং একজন প্রধান শিক্ষক ছাত্রীর শ্লীলতাহানী করেছেন- এমন খবরও পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। পাবনায় এক স্কুল শিক্ষককে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। মানিকগঞ্জে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে এক শিক্ষককে পুলিশে দিয়েছে জনতা। শিক্ষকদের এই অনভিপ্রেত ও পাশবিক এবং ন্যক্কারজনক আচরণ থেকে একটি পরিষ্কার সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে যে, মনুষ্যত্বের কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে চলেছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
উপরোল্লিখিত পরিসংখ্যান একটি খ-চিত্র মাত্র। সমগ্র দেশের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। এভাবে একটার পর একটা লোমহর্ষক, বীভৎস ও পৈশাচিক পারিবারিক এবং সামাজিক ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। এসবের জন্য আমরা কাকে দায়ী করব, নিশ্চয় শাসনকে; আর শাসন করেন কার্যত যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারাই। দেশে সুশাসন থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে একজন মানুষকে যখন কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে অপরাধীরা বীরের বেশে চলে যায়, তখন সমাজে অপরাধ করতে অন্যরাও উৎসাহ পায়।
দেশে যৌন হয়রানি ও পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার এবং বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে গাজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ অন্যান্য নেশাদ্রব্যের সহজলভ্যতারও। পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব ও ধর্মীয় শিক্ষায় উদাসীনতাও সামাজিক অপারধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশে আজ অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের হাতে হাতে ইন্টারনেট সংযোগসহ মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোন। এই ফোনগুলোতে অনায়াসে অশ্লীল ও পর্নোছবি ডাউনলোড করা যায়। সাথের বন্ধুদের নিয়ে নির্জন জায়গায় বসে এসব পর্নো ছবি দেখে থাকে অপ্রাপ্তবয়স্করা। এ থেকেই তাদের মাঝে অপারাধ প্রবণতা জাগ্রত হচ্ছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সঙ্গে। তাতে সমাজে বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতন। এ ব্যাপারে পরিবারের দায়িত্ব অপরিসীম। দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রেরও।
ভালো মানুষ বা অন্য ভালো যা অর্জন, তা সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই সূচিত হয়। সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা অনেকটা পরিবারের ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষের প্রথম নিরাপত্তা তার পরিবারে। পরিবার বলতে টুকরো টুকরো পরিবার নয়, যৌথ পরিবার; যৌথ পরিবারে মানুষের মন-মনন ও নৈতিকতা-মূল্যবোধ এবং মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। আয়-উন্নতিও যৌথ পরিবারে বেশি হয়। সুতরাং যৌথ পরিবার গড়তে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রকে দিতে হবে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা; রাষ্ট্রের সার্বিক শাসন কাঠামোও হতে হবে যৌথ পরিবার গড়ার মুখী।
পরিবার হলো মায়া-মমতার বন্ধন; এই মায়া-মমতার সূতোয় বাঁধা থাকে পরিবাবের প্রত্যেক সদস্যের জীবন। যৌথ পরিবারে মায়া-মমতা ও আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের যে সুযোগ থাকে। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকভাবে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, একটি পরিবার ভেঙে একাধিক পরিবার হয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার নিজ হাতে গড়া সবচে বড় সম্পদ পরিবার নিজেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন। সদস্যরা তাদের পরিবারের ভেতরই নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছেন। যৌথ পরিবারে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ভীতও থাকে মজবুত। কাজেই সমাজের ক্ষতি হয় এমন কোনো আচরণ তাদের দ্বারা সংঘটিত হয় না; মাদকাসক্তি ও আইন বিরোধী এবং অপরাধমূলক যাবতীয় কাজ থেকেও তারা নিজেদের দূরে রাখে।
বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংখ্যা ত্রুমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে সমাজে দিন দিন ভয়ঙ্কর সব পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ট্র্যাজেডি, বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যাও। পরিবারে সংঘটিত নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নেতীবাচক প্রভাব কোনো না কোনো ভাবে রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়, বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে; রাষ্ট্রকে ‘ক্রসফায়ারের’ নামে প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করেই টিকে থাকতে হচ্ছে।
গত কয়েক মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভয়ানক হারে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। এই পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের গত এক বছরের ‘ডিভোর্স রেকর্ড’ পর্যালোচনায় পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে এগিয়ে মেয়েরা। শতকরা সত্তর ভাগ তালাক আবেদন জমা পড়েছে মেয়েদের তরফ থেকে। শুধু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের চিত্রও একই। পরিবার ভাঙার ঘটনা ছাড়াও, পরিবার একেবারে ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে মেয়েদের তরফ থেকে বেশি, যা সমাজ বিশ্লেষকদের রীতিমত স্তম্ভিত ও হতবাক করছে।
বর্তমানে তথ্যের রাজ্যে বাধাহীন, অবাধ বিচরণের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও বিদেশী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল। ফলে সমাজ জীবনে বয়ে নিয়ে আসছে বিপজ্জনক সব ভাইরাস, বয়ে নিয়ে আসছে অপসংস্কৃতি, অশ্লীল, উলঙ্গ ও বিকৃত সব ছবি বা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কিছু। প্রযুক্তি আমাদের সামনে বিশ্বের অবারিত জ্ঞানের দরজা উম্মুক্ত করে দিয়েছে। যার ফলে প্রযুক্তির পথ রোধ করা মানে জ্ঞানের অবাধ প্রবেশ ব্যাহত করা। কিন্তু পরিবারের দায়িত্বহীনতার কারণে খারাপ নেতিবাচক অশ্লীল কিছু বিষয় আমাদের তরুণ-তরুণীদের মাঝে অনুপ্রবেশ করছে। কলুষিত করছে আমাদের প্রজন্মকে। এর প্রতিকার প্রথমে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। পরিবারকেই নিতে হবে অগ্রনী ভূমিকা।
সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে, পরিবারের ভেতর ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য। শুধু ইসলাম নয়, প্রত্যেক ধর্মেই সৎ চরিত্র গঠনের নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্তানদের ছোট থেকেই পড়াÑ লেখার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দেয়াও বাধ্যতামূলক। ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েদের ‘এনার্জি’ সঠিক পথে ব্যবহৃত হয়, তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি হয় পরিশুদ্ধ। অন্যায়, পাপাচার, কাম-ক্রোধ মোহ ও যাবতীয় লোভ-লালসা এবং অযাচিত চাওয়া পাওয়া তাদের মনোবৃত্তিকে দুর্বল করতে পারে না।
ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছেলে-মেয়েদের দর্শন ও মূল্যবোধ তৈরি হয় পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার আলোকে, তাদের কাছে নর সুরক্ষিত, নারীও সুরক্ষিত; সুরক্ষিত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। তারা জানে অন্যের মা বোনের ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট হলে, অনুরূপ ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট হবে তাদের মা-বোনদেরও। এটিই সামাজিক মূল্যবোধ, ভয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। আর এটি তৈরি হয় মূলত ধর্মীয় অনুশাসন থেকে। সুতরাং সমাজের ক্ষীয়মান মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হলে, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি সবার মনোনিবেশ করা অত্যাবশ্যক।
তাছাড়া পরিবারের যিনি কর্তা বা প্রধান ধৈর্য্য, সংযম, ক্রোধ, মোহ ও অযাচিত লোভ-লালসার মাত্রাও তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অত্যাবশ্যক। যে সন্তান বেড়ে উঠবে পারিবারিক আদাব-সোহাগ ও মায়া-মমতার ওপর ভিত্তি করে, সে বেড়ে উঠছে ভোগ বিলাস বা চাওয়া-পাওয়ার মনোভাব নিয়ে। ফলে অল্প বয়সেই তাদের চেতনায় লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ ও মোহ এবং হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে। গা শিউরে উঠার মতো সামাজিক অপরাধ প্রবণতার দিকে এরা ঝুঁকে পড়ছে। ভয়ঙ্কর ও হিংস্র মনোভাবাপন্ন স্বভাব-চরিত্র তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, সর্বস্তরে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। সভা, সেমিনার গোলটেবিল বৈঠক, টিভি টকশো, মতবিনিময় সভা ইত্যাদির মাধ্যমে এই সামাজিক আন্দোলনের অপরিহার্যতার বিষয়টি ‘ফোকাসে’ আনতে হবে। এছাড়াও আলেম সমাজ, মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
আমরা পরিবার গঠন বা ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের দৈহিক সৌন্দর্য, বংশ মর্যাদা ও ধন-সম্পদকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় অনুশাসনকে গুরুত্ব দিইনা। দৈহিক সৌন্দর্য, বংশ মর্যাদ ও ধন-সম্পদ পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবে না-যদি ধর্মীয় শিক্ষা না থাকে। আজ সমাজে মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, তার অন্যতম কারণ ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় অনুশাসনকে গুরুত্ব না দেয়া। মানুষের মন-মনন ও পরিবার গঠনে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই-এই অনিবার্য সত্যটি সবার মাঝেই জাগ্রত হতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, মানুষের মনে আজ মরচে ধরেছে। দেশের কোটি কোটি যুবক শরীরে বেঁচে থাকলেও তারা ভেতরে ভেতরে মরে গেছে। মরণঘাতী নেশা ও অপসংস্কৃতির ছোবল তাদের জীবনী শক্তি কেড়ে নিয়েছে। নেশা ও অপসংস্কৃতির মরণব্যধি তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। খাচ্ছে তাদের ইচ্ছাশক্তি, কল্পনাশক্তি, মেধাশক্তি, দৈহিক শক্তি ও মানসিক শক্তিকেও। যে দেশের যুব সমাজের বিরাট একটি অংশের এ পরিণতি, সে দেশের ভবিষ্যৎ কি? সে দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় কি? হ্যাঁ, উপায় আত্মজাগরণে ও মনুষ্যত্ব জাগরণে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য, রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে জাতিকে কোনভাবেই বের করে আনা সম্ভব নয়।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belaYet_1@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন