শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

মৃৎশিল্পের গ্রাম কুমিল্লার বিজয়পুর

কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৭ এএম

মৃৎশিল্পের গ্রাম মানেই কুমিল্লার বিজয়পুর। আর বিজয়পুরের মৃৎশিল্প ঘিরে আশপাশের দুর্গাপুর, বারপাড়া, টেগুরিয়াপাড়া এবং নোয়াপাড়াসহ আরো কিছু গ্রামের চার শতাধিক পরিবার ৫৫ বছরের বেশি সময় ধরে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে বাজারজাতের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও রয়েছে এখানকার মৃৎশিল্পের ব্যাপক চাহিদা। রোদ বৃষ্টি ঝড় কোনটাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না ওদের সামনে। বংশ পরম্পরায় মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজটা পরম মমতায় করে যাচ্ছেন। অনেক ঘাত প্রতিঘাত দু:খ দুর্দশা পেরিয়ে কুমিল্লার মৃৎশিল্পের কারিগররা এখনো তাদের সফল হাতে ঘুরাচ্ছেন নিজেদের ভাগ্যের চাকা। আর এ চাকা কেবল এশিল্পের কারিগরদেরই নয়, যারা মৃৎশিল্পের ব্যবসার সাথে জড়িত হয়েছেন তারাও পাচ্ছেন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
সমবায়ের জনক বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি’র (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা ড.আখতার হামিদ খান মৃৎশিল্পের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে মাত্র দেড়শ’ টাকা আমানত সংগ্রহ করে কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কের পশ্চিমপার্শ্বে বিজয়পুরে রুদ্রপাল বংশের ১৫ সদস্য নিয়ে ১৯৬২ সালে কুমিল্লার মৃৎশিল্পীদের একমাত্র প্রতিনিধিমূলক সংগঠন রুদ্রপাল সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মৃৎশিল্পের কার্যক্রম শুরু করেন। চারযুগ ধরে এলাকার হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে প্রায় চারশ’ পরিবারের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে এই শিল্পের মাধ্যমে।
কুমিল্লার মাটির তৈরি বাহারি ডিজাইনের জিনিসপত্র দিন দিন নজর কাড়ছে ঘরের মানুষদের। দোকানে ফুটপাতে মিলছে চোখ ধাঁধানো মৃৎশিল্পের। আর এসব মৃৎশিল্প বিক্রি করে নিরবইে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জন করছেন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা। কেবল কুমিল্লার ব্যবসায়িরাই নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, সিলেট, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ফেনি, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জসহ আরো কয়েকটি জেলায় কুমিল্লার মৃৎশিল্পের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটিয়ে সেখানকার ব্যবসায়িরাও ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। কুমিল্লার মৃৎর্শিল্পীদের তৈরি নান্দনিক রুচিসম্পন্ন আধুনিক কারুকার্য খচিত ক্রোকারিজসহ শোপিছ সামগ্রী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে ব্যাপক চাহিদার জায়গাটি স্থান করে নিয়েছে। কুমিল্লার মাটির তৈরি শিল্পকর্মের উত্থান ঘটেছে সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের বিজয়পুরসহ বেশ কিছু গ্রামের কয়েকশত পরিবারের হাত ধরে। তাও প্রায় ৫৬ বছর আগে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসেও একবিন্দু কদর কমেনি কুমিল্লার মৃৎশিল্পের। বরং দেশ বিদেশে এখানকার মৃৎশিল্পীদের হাতের তৈরি মাটির হাঁড়ি, পাতিল, বাটি ,বদনা, মটকা, প্রদীপ, ছাইদানী, গেলাস, সানকি, ঘড়া, কল্কি, গামলা, জলাবিড়া, জটধুসি, জলকান্দা, চুনপাত্র, সরাই, দুধের হাড়ি, ফুলদানী, মালসা, থালা, পানের বাটা ,সন্ন্যাসীর গাড়–, খেলনা, কলস, মুবঘট ,লক্ষীঘট, আয়োঘট,পুজারঘট, দোয়াত বৈয়াম, দুধ সানার পত্র, লক্ষীসরা, মটকা, কাজলবাটি নাদা, তবলার বায়া, মৃদংগ নাল, পাখোয়াজের মাটিরখোল, গাছাপ্রদীন, দইছোবা, ক্রোকারিজ, শোপিচ সামগ্রীসহ অসংখ্য রকমের দৃষ্টিনন্দন জিনিসপত্র অসাধারণ নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। কুমিল্লায় তৈরি মৃৎশিল্পের নান্দনিক রুচিসম্পন্ন আধুনিক ধারার কারুকার্য খচিত ক্রোকারিজসহ শোপিছ সামগ্রী রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপ, হল্যান্ড, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। বিদেশীরাও পরম যতে্ন ঘরে, অফিসে সাজিয়ে রাখছেন কুমিল্লার মাটির তৈরি শিল্পকর্ম। বিদেশে রপ্তানী ছাড়াও এখানকার তৈরি মাটির বিভিন্ন সৌখিন সামগ্রী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, কক্সবাজার, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও, ফেনি, লক্ষীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, সিলেটসহ অন্যান্য জেলার ব্যবসায়িরা নিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার শিশু একাডেমী প্রাঙ্গন, রমনাপার্ক ও হাইকোট এলাকা, ধানমন্ডি ল্যাবএইড রোড, কলাবাগান, চট্রগ্রামের হাটহাজারী বাজার, নোয়াখালীর চৌহমুনীতে কুমিল্লার মৃৎশিল্পের পসরা বসে থাকে প্রতিদিনই। কুমিল্লা মহানগরীর জিলা স্কুল রোডে ও বাদুরতলায় মৃৎশিল্প সামগ্রী বিক্রির বেশ কটি দোকান রয়েছে। কুমিল্লার ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলোর সামনেও পসরা সাজিয়ে বিজয়পুরের মাটির তৈরি নানা সামগ্রী বেচাবিক্রি হয়ে থাকে। কুমিল্লার মৃৎশিল্পের ব্যবসায় জড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার অনেকেই আজকে প্রতিষ্ঠিত। বিদেশের মাটিতে যারা কুমিল্লার মৃৎশিল্প ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছেন তারাও তো সম্মান ও অর্থনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় রয়েছেন। সবমিলে কুমিল্লার মৃৎশিল্প যেমন দেশের ঐতিহ্য সমৃদ্ধি করে তুলছে তেমনি এ ব্যবসায় খুলে দিয়েছে সচ্ছল জীবন যাপনের সম্ভাবনার দুয়ার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন