এক সময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে রান্নাবান্না, খাওয়া-থাওয়া আর অতিথি আপ্যায়ন, প্রায় সব কাজেই মাটির তৈরি হাড়ি পাতিলের ব্যবহার ছিলো। স্বাস্থ্যকর আর সহজ লভ্য ছিলো বলে সব পরিবারেই ছিলো মাটির পাত্রের ব্যবহার।
শীতে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য হাড়ি, বাহারি চিতই, পুলি ও বাঁপা পিঠাসহ নানান জাতের পিঠার জন্য খোলা, দধির পাতিল, টালি, বড্ডুয়া, ধুতি, ঘট, মুচি, মুটকি থালা, বাসনসহ বিভিন্ন মাটির সরঞ্জাম তৈরি করতো গ্রাম বাংলার কুমাররা। সেগুলো ভ্যান বা মাথায় করে বিক্রি করেই চলতো তাদের সংসার। খড়, কাঠি আর মাটির সাথেই তাদের জীবনপণ যুদ্ধ ছিলো।
তাদের এই বাহারি মাটির তৈরি সরঞ্জাম তৈরি দেখতে বিড় জমতো শত শত দর্শকদের। আর চুলোয় আগুন দেবার সময় আয়োজন করতো কুমাররা, মিষ্টি কিংবা ছিড়ার মোড়া বিলি করতো তারা। সময়ের পেক্ষাপটে হারিয়ে গেছে এসব চিত্র। এখন তারা কুমার পেশা ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন পেশায় ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের ঐতিহ্য আর গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি।
সুবর্ণচরে এখন মাত্র ২০টি পরিবার মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত। সরেজমিনে গিয়ে সুবর্ণচর উপজেলার পুর্বচর বাটা ইউনিয়নের ছমিরহাট বাজারের পশ্চিমে আরজি স্কুলের পাশে কয়েকজন কুমারের সাথে কথা হয়। বিমল পাল নামে এক কুমার ও তার স্ত্রী তাদের দুর্বিসহ যন্ত্রণার কথা বলেন। এ পেশায় ঠিকমতো সংসার চলে না তাদের। খেয়ে না খেয়েই কাটে তাদের সংসার। এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যাবার পুঁজি নেই বলে পেশা পরিবর্তন করতে পারছেন না তারা।
ধনেশ্বর পাল নামে এক কুমার জানান, এক সময় মাটি পেতাম বিনামূল্যে, আর গত দু’বছর আগেও তা ছিলো মাত্র চারশ’ টাকা প্রতি গাড়ি। আর এখন তা বারোশ’ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কাঁচামালগুলো পোড়াতে কাঠ আর খড়ের দাম বেড়েছে কয়েকগুন। সব মিলিয়ে বাজারের সব কিছুর দাম বাড়লেও দাম বাড়েনি মাটির তৈরি সরঞ্জামের । একটি খোলা তৈরিতে প্রায় দশ টাকা খরচ হলেও বিক্রি হয় বারো টাকা।
এ সময় হরিকমল পাল, মনোরঞ্জন পাল, বিরেশ্বর পালও জানান একই কথা। সরঞ্জামাদি তৈরিতে খরচের সাথে বাজার মূল্য নেই। এছাড়াও আগের মতো এখন আর মাটির পাত্রের চাহিদাও নেই। কারো প্রয়োজন হলে মাঝে মধ্যে নেন। বছরের অধিকাংশ সময়ই কাটে বসে থেকে। এ পেশায় থাকার কারণে আর কোনো কাজ করতে পারেন না তারা। এজন্য সংসার চালাতে কষ্ট হয়।
এক সময় পালদের সবাই ছিল কুমার পেশার সাথে, এখন আর নেই। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পড়াশোনা করে চাকরি আর নানা পেশায় বিচরণ তাদের। এরকম কয়েকজন সাথে কথা হয়। খোকন চন্দ্র পাল এখন কৃষি ব্যাংকে চাকরি করছে, অনুপম পাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আর শিমুল পাল স্বাস্থ্যকর্মি । তারা জানান, লেখাপড়া করে তারা কয়েকজন চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও অধিকাংশই কষ্ট করে হলেও বাপ-দাদার এ পেশা চালিয়ে যেতে বাধ্য।
তারা আরও জানান, সরকারি সহযোগিতা আর বাজারের চাহিদা থাকলে হয়তো হাজার বছরের ঐতিহ্য এ পেশাটি টিকে থাকতে পারবে। নতুবা কালের আবর্তনে হারিয়ে যাবে মৃৎ শিল্প। এ শিল্পকে ধরে রাখতে সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি জনসাধারণকে মাটির পাত্রের ব্যাবহারের পরামর্শ জানান।
এ বিষয়ে সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম ইবনুল হাসান ইভেন জানান, ইতোমধ্যে কয়েকটি পরিবারকে সরকারি ভাবে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে মাটির পাত্রের ব্যবহারের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। সরকারি ভাবে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে উর্দ্ধতনের সাথে পরামর্শ করে আরও ফলপ্রসু ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন