বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

বিজয়ের মাস ও আমাদের কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:২০ এএম, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

হোসেন মাহমুদ : ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল চূড়ান্ত বিজয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ধ্বংস ও মৃত্যুর পাথার পেরিয়ে তবেই এ স্বাধীনতা এসেছে। এতে প্রাণ দিয়েছেন তিরিশ লাাখ মানুষ, দু’লক্ষাধিক মা-বোন হারিয়েছেন তাদের অমূল্য সম্ভ্রম। এ বিজয় অর্জনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন আমাদের দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা। ঝড়-বৃষ্টি তাদের মুক্তির অভিযাত্রায় বাধা হতে পারেনি, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রচ- গোলাগুলি তাদের শংকিত করতে পারনি, কোনো বাধা তাদেরকে সংকল্পচ্যুত করতে পারেনি। মৃত্যুকে হেলায় জয় করে তারা ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতাকে। দেশের সকল শ্রেণির মানুষের সার্বিক সমর্থনে অর্জিত হয় এ বিজয়। দেশের নানা স্থানে পাকিস্তানি  সৈন্য ও তাদের দোসরদের সাথে যুদ্ধে তারা রচনা করেন গৌরবের উজ্জ্বল ইতিহাস। তাদের অপরিসীম সাহস ও বীরত্বের কথা আজো এ দেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কবির ভাষায়Ñ ‘তারা এ দেশের সবুজ ধানের শীষে চিরদিন আছে মিশে।’ এ মুক্তিযোদ্ধারা জাতির কাছে বরিত হয়েছেন সূর্য সন্তান হিসেবে। তাদের ত্যাগ, তাদের আত্মদানের কথা জাতি কখনো ভুলবে না। তাদের কাছে আমাদের যে ঋণ সে ঋণ  কোনোদিন শোধ হবে না।
বিজয়ের এবার ৪৫ বছর পূর্তি হলো। যারা প্রাণ হাতে নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন তাদের অনেকেই আজ নেই। যারা আছেন তাদের কেউ কেউ খুবই ভালো আছেন। কেউ বিশিষ্ট শিল্পপতি হয়েছেন, কেউ বড় আমলা হয়েছেন, কেউ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হয়েছেন, কেউ বা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েছেন। কেউবা হয়েছেন স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউবা নামী স্থপতি, প্রকৌশলি। আবার অনেকেই তেমন কিছু হতে পারেননি। আর কেউ কেউ থেকে গেছেন একেবারেই ভাগ্যাহত। তাদের এক সময়কার আলোকোজ্জ্বল জীবন ঢাকা পড়ে গেছে অতল অন্ধকােের। তাদের কেউ হয়েছেন রিকশাওয়ালা, কেউ বা হয়েছেন ভিক্ষুক, কেউ হয়েছেন চা দোকানদার।  অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাননি।  ফলে সাম্প্রতিক কালে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে ভাতার প্রচলন করেছে তা তারা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে বিপুল সংখ্যক নারী সম্ভ্রম হারান তাদের একটি বড় অংশই দুঃখ-দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সরকার প্রদত্ত সামান্য আর্থিক সুবিধাও তারা পাচ্ছেন না।
আগে দেশের পত্র-পত্রিকাগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখ-কষ্টের খবর বিজয়ের মাসে ফলাও করে প্রকাশিত হতো। এখন আর তেমন হয় না। এর কারণ হতে পারে এই যে, মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশই মারা গেছেন অথবা তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে, এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন এবং সবার অবস্থার উন্নতি হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্র জাতির এ সব সূর্য সন্তানদের সবার প্রতি সুবিচার করেনি।  দু’একটি অনলাইন পত্রিকায় তাদের সম্পর্কে কিছু কিছু খবর প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। উল্লেখ্য, এ সব খবর পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত নয়। তারপরও এগুলো থেকে দেখা যায় যে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের অনেকেই এখনো সরকার ও সমাজ কর্তৃক উপেক্ষিত, অবহেলিত। তাদের মেলেনি প্রয়োজনীয় স্বীকৃতিও।
বলা দরকার,  আমাদের স¦াধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। পরম বেদনার সাথে বলতে হয় যে, সে লক্ষ্য বহুলাংশেই আজো পূরণ হয়নি। বিজয়ের মাসে জাতির বৃহত্তর অংশ যখন বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত, তারা রয়ে গেছেন আনন্দ-উল্লাস বঞ্চিত আঁধারের অধিবাসী হয়ে। যেমন মুরাদ আলি।   
যে হাতে একদিন দেশকে মুক্ত করার জন্য অস্ত্র ধরেছিলেন সে হাতে ভিক্ষা চাওয়ার কথা কখনো ভাবেননি ৭০ বছর বয়স্ক মুরাদ আলি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে তিনি একজন ভিক্ষুক। একই সাথে ভাগ্য তাকে আরো বঞ্চনা করেছে। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি তার মেলেনি আজো। ১ ডিসেম্বর অনলাইন সংবাদপত্র তাজাখবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার অঞ্জনগাছি গ্রামের মুরাদ আলি গ্রামের আরো কয়েকজনের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।  কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আনসার কমান্ডার তবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তারা মুক্তিযুদ্ধ করেন। দেশ স্বাধীন হয়। তার সহযোদ্ধাদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান পেলেও মুরাদ আলি বাদ পড়েন। তার কথা, বহু চেষ্টা করেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। তিনি যে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এ মর্মে আনসার কমান্ডার তাকে লিখিত সুপারিশপত্রও দেন। তাতেও কাজ হয়নি। একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গনি, আরজুল হক ও ছাত্তার বলেন, মুরাদ আলি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার নজরুল করিম বলেন, মুরাদ আলি প্রকৃতই একজন মুক্তিযোদ্ধা। একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গনি, আরজুল হক এবং ছাত্তারও একই কথা বলেন। যাহোক, এক পর্যায়ে স্ট্রোকের শিকার হন তিনি। এতে তার শরীরের ডান পাশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। সংসারে তার স্ত্রী, চার মেয়ে ও এক ছেলে। তার উপর বার্ধক্য। অনাহার-অর্ধাহারের শিকার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ধরা হাত ভিক্ষার হাতে পরিণত হয়। চার বছর আগে ভিক্ষা করা শুরু করেন তিনি। মৃত্যুর আগে তার নাম মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে অর্ন্তভুক্ত হবে কিনা তিনি জানেন না। মুরাদ আলি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে জয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু আজ জীবনযুদ্ধে আমি পরাজিত। তিনি জানান, নিরুপায় হয়ে ভিক্ষার পথ বেছে নিলেও এখন আর বেশি হাঁটতে পারেন না, ফলে ভিক্ষার জন্য দূর-দূরান্তে যাওয়া সম্ভব হয় না, ভিক্ষাও তেমন মেলে না। নজরুল করিম বলেন, আমরা এখন তার ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করেছি। বেসরকারি পর্যায়ে তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মুিক্তযোদ্ধা হয়ে তিনিও এখন একজন ভিক্ষুক। একদিন যিনি জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা সেই হাতে এখন ভিক্ষা চান মানুষের কাছে। স্বাধীনতার যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছিলেন বটে, কিন্তু জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারেননি। তিনি হচ্ছেন লাল মিয়া। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া শেখেননি। কিশোর বয়সেই ভূমি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭০ সালে ১৯ বছর বয়সে চলে যান চাচার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ^ম্ভরপুর থানার চান্দারগাঁও গ্রামে। ভর্তি হন আনসার বাহিনীতে। ’৭১-এ যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন। ৫ নং সেক্টরে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ করেন তিনি। যুদ্ধ শেষ হলে জেনারেল ওসমানি স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে কিশোরগঞ্জে ফিরে আসেন। তিনি বিয়ে করেন ও কয়েক সন্তানের পিতা হন। এরপর প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ায় বাম পা ও বাম হাত অচল হয়ে পড়ে। গ্রামে সংসার না চলায় তিনি চলে যান নরসিংদীর পলাশে। শারীরিক অক্ষমতার জন্য তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। চার ছেলের তিনজন বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। নিজেদের সংসারই চালাতে পারে না তারা, বাবাকে সাহায্য করবে কি। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেছেন তিনি। লাল মিয়া বাস করেন পলাশ উপজেলার গাবতলি গ্রামের একটি এক হাজার টাকা ভাড়ার মাটির ঘরে। সারাদিন ভিক্ষা করেন পলাশ ইউরিয়া সার-কারখানার গেইটে বসে। এ অবস্থায়ও তার ছোট ছেলেকে কলেজে পড়াচ্ছেন তিনি। এদিকে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া শুরু করার পর তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন।  তবে ভাতার টাকা আনতে তাকে পলাশ থেকে যেতে হয় সুনামগঞ্জে। যাওয়া-আসা ও সেখানে গিয়ে অবস্থান করা বাবদ ভাতার টাকার একটি বড় অংশ বেরিয়ে যায়। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ধিত ভাতা পাওয়া শুরু হলে ভিক্ষাবৃত্তির অবসান হবে বলে তিনি আশা করছেন। ভিক্ষার পথ বেছে নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সফর আলিও। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের মনরাজ গ্রামের যুবক সফর আলি ছিলেন মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য। দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে ’৬৯ সালে চাকুরি ছেড়ে দেন। অংশ নেন আওয়ামী লীগের মিটিং-মিছিলে। সেই উত্তাল দিনগুলো পেরিয়ে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। মেজর সি আর দত্তের অধীনে ৪ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন।  যুদ্ধশেষে গ্রামে ফেরেন। তারপর একটি কাজের আশায় অনেক নেতার কাছেই ঘুরেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কেউ তার কোনো কাজের ব্যবস্থা করেননি। তিনি রিকশা চালানো শুরু করেন। সে আয় দিয়েই সংসার চলত তার। কিন্তু এখন আর শরীরে শক্তি নেই। রিকশা চালাতে পারেন না। স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে। বর্তমানে তিনি কুলাউড়া উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের মনসুর গ্রামে বাস করেন। নিজের কোনো জমি-জমা বা ভিটে-বাড়ি নেই। শ^শুর বাড়ির একটুকরো জমিতে যাযাবরের মত বাস করেন। মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল থেকে মাসে ২ হাজার টাকা ভাতা পান তাতে কিছুই হয় না। প্রকৃত পক্ষে মানুষের করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাকে। তার ডান হাতে পচন ধরেছে। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য গেলে তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। জীবন সায়াহ্নে এসে তার আর্তি একটু মাথা গোঁজার আশ্রয়ের জন্য, চান দু’বেলা দু’ মুঠো ভাত। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান নয়, এগুলোই তার জরুরি প্রয়োজন।   
মহেশপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব উদ্দিনের দিন কাটে এখন চা বিক্রি করে। তিনি ছিলেন মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য। এলাকার আরো অনেকের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তিনি যুবক। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের সাথে লড়াই করে মহেশপুরকে করেছেন শত্রুমুক্ত। ’৭১ সালের ২০ নভেম্বর দত্তনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে একটানা কয়েকদিন ধরে যুদ্ধে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। হাতে গুলি ও পায়ে সপ্লিন্টার লেগে আহত হন। এ সময় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তার স্ত্রী মারা যান। কিন্তু যুদ্ধে থাকায় তিনি তার দাফনেও যেতে পারেননি। যুদ্ধের পর তিনি লেখাপড়া না জানায় কিছু করতে পারেননি। অনেকদিন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালিয়েছেন। বর্তমানে তিনি মহেশপুর পুরাতন সোনালি ব্যাংকের মধ্যে একটি ছোট চা’র দোকান চালান। এ থেকে সামান্য আয় ও সাম্প্রতিক কালে চালু হওয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে টেনেটুনে তার সংসার চলে। তার পাঁচ সন্তান। ভালো কোনো ঘর-বাড়ি নেই। বৃষ্টির দিনে ঘরে পানি জমে যায়। মহেশপুরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মালেক গাজী বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব উদ্দিন চা’র দোকান দিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা তার চেয়েও আর্থিক সংকটে দিন কাটান।
স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছিলেন ৪৫ বছর আগে। কিন্তু এতদিনেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি কুড়িগ্রামের ঘোগাদহ ইউনিয়নের মরাটারী গ্রামের সফিয়ার রহমান। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তখন তার বয়স ছিল ২১ বছর। তিনি ছিলেন ৬ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। তার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি আসামের আলিপুর দুয়ার থানাধীন ঝাউকুঠি ক্যাম্পে বাংলাদেশ ইয়ুথ রিসেপশন ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে সহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বহু মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি প্রশিক্ষণ দেন। তার কাছে তৎকালীন এমএনএ সামছুল হুদার স্বাক্ষর করা প্রাইমারি ট্রেনিংয়ের সার্টিফিকেট রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি তার পৈত্রিক বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর থানাধীন যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুর্গম ঝুনকান চরে ফিরে যান। পরে তিনিও কারো সাথে যোগাযোগ রাখেননি বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেউ তার খোঁজও করেনি। ফলে মুক্তিযোদ্ধা হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম ওঠেনি তার। তাদের এলাকায় সর্বশেষ ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়। তাতেও তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ২০১৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু এখনো কোনো সাড়া পাননি। তার অভিযোগ, কাউন্সিলে দীর্ঘদিন ঘোরাঘুরি করেও লাভ হয়নি। ঘোগাদহ ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার জন্য সুপারিশ করেছেন। তিনি জানান, সফিয়ার রহমানের আবেদনটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছেও আবেদন করেছেন তিনি। ৬৬ বছর বয়স্ক সফিয়ার রহমান মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পেয়ে হতাশ। যেহেতু তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকভুক্ত নন তাই সরকারের দেওয়া ভাতাও পান না। তার ইচ্ছা, জীবন সায়াহ্নে এসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে চোখ বন্ধ করবেন তিনি। সেই হবে তার পরম শান্তি।    
এবার এক বীরাঙ্গনার কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী মুক্তিযোদ্ধদের কেউ কেউ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মুখোমুখি লড়াই করেছেন, এমন ঘটনা সম্ভবত নেই। যদিও তারামন বিবি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে দেয়ার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে রাইফেল চালানো শেখেন ও দু’একবার লড়াইয়ে অংশ নেন বলেও জানা যায়। মুক্তিযোদ্ধা নারীদের প্রায় সবাই সেবা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কেউ কেউ মহিলাদের সংগঠিত করার কাজও করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ২  লাখ নারী তাদের সম্ভ্রম হারান। স্বাধীনতার পর পর তারা সরকার কর্র্তৃক বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তবে সবাই এ স্বীকৃতি পাননি। মূলত সম্ভ্রম হারানো নারীদের বেীির ভাগই এখনো এ স্বীকৃতির বাইরে রয়ে গেছেন।  এমনই একজন হলেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের স্বীকৃতি না পাওয়া বীরাঙ্গনা হাজেরা খাতুন। ৯ ডিসেম্বর হাজেরার বঞ্চনা ও করুণ জীবন কাহিনী তুলে ধরেছে অনলাইন পত্রিকা সময়ের নিউজ। জানা যায়, ’৭১ সালে বিজয় দিবসের ১৪ দিন আগে অর্থাৎ ২ ডিসেম্বর হালুয়াঘাট থেকে ৪ কি. মি. দূরবর্তী গোবড়াকুড়া গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন হাজেরা। এদিন তার স্বামীকেও হত্যা করে তারা। দীর্ঘদিন তিনি কিছু পাওয়ার আশা করেননি। কিন্তু এখন অশক্ত হয়ে পড়া শরীর আর অভাবের জ¦ালা সইতে না পেরে গত বছর তিনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাওয়ার আবেদন করেন। স্থানীয় মুিক্তযোদ্ধারা তার প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। হাজেরা এখন বাস করেন কাগজ আর পাতায় ছাওয়া একটি কুঁড়েঘরে। হালকা বৃষ্টিতে ভিজে যায় কুঁড়েঘরের ভিতরটা। হাজেরা যদি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পান তাহলে সরকারের প্রদত্ত ভাতা প্রাপ্য হবেন। তাতে সমাজে সম্মান না জুটলেও কষ্টের দিনগুলো পার করা হয়তো একটু সহজ হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অমূল্য সম্ভ্রম হারানো হাজেরার পক্ষে এই হয়তো হবে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
 লেখক : সাংবাদিক
h_mahmudbd@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Melvina ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:১২ পিএম says : 0
The voice of rationality! Good to hear from you.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন