শেখ দরবার আলম : যে কোনো সুস্থ জীবনবোধসম্পন্ন মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চান। যে কোনো সুস্থ জীবনবোধসম্পন্ন দেশনেতা বা দেশনেত্রী তাদের দেশটাকে স্বাধীন রাখতে চান। কোনো মানুষ অর্থনৈতিক কিংবা শারীরিক দিক দিয়ে খুব অসহায় বা দুর্বল হলে তার স্বাধীনতা অন্য মানুষদের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়। কোনো দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল হলে অন্য এক বা একাধিক দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
ব্যক্তি মানুষ অর্থনৈতিক ও শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল হলে কার ওপর কিংবা কার কার ওপর নির্ভর করলে তার স্বাধীনতাটা নিরাপদ হতে পারে সেটা নির্ধারণ করাটা যেমন তার বিচক্ষণতার ও দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করে, অনুরূপভাবে ঠিক তেমনি কোনো রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল হলে তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ রাখতে কোনো দেশের ওপর বা কোন কোন দেশের ওপর নির্ভর করাটা উচিত হবে সেটা সেই দেশের নেতা বা নেত্রীর শিক্ষা-দীক্ষা এবং বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করে। এতে অপরিহার্যভাবে ইতিহাসজ্ঞান দরকার হয়। পঞ্চাশ-একশ বছরের ইতিহাস জ্ঞান দিয়ে চলে না। দরকার পাঁচশ হাজার বছরের ইতিহাসজ্ঞান। অন্তত তিনশ-সোয়া তিনশ বছরের ইতিহাসজ্ঞান।
দুই . আমি ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের অন্তত পঞ্চাশ বছর আগের পত্র-পত্রিকা ফাইল ঘেঁটে তারিখ-তথ্য সংগ্রহ করার কাজ করেছি। কৈশোর থেকে দৈনিক ও সাময়িক পত্র পড়ে জ্ঞান-গম্যি অর্জনের চেষ্টা করি। আমি দুনিয়া দেখি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং বইপত্রের মাধ্যমে। কোনো বড় দেশে লং ড্রাইভে গিয়ে দুনিয়া দেখার সুযোগ আমার কখনো হয়নি। আমি যা পড়ি তা মনে মনে অনেক কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করি, উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। তা সে একান্ত ব্যক্তিগত গোপন জীবনের বিষয় হোক, কিংবা বাইরের দুনিয়াদারির বিষয় হোক।
আমার খুব স্পষ্টভাবেই মনে হয় যে, ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের আগে স্বাধীনতা সম্পর্কে মুসলমান সমাজের নেতা-নেত্রী এবং বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাভাবনা এবং কথাবার্তা ছিল এক রকম। আর ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম প্রধান দেশের সমাজহীন মুসলমান সমাজের নেতা-নেত্রী এবং বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাভাবনা এবং কথাবার্তা হয়েছে আর এক রকম। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পরাধীন ভারতে অনেক বিষয়ে অধিকার-বঞ্চিত হয়ে থেকেও মুসলমান সমাজের নেতা-বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীন ছিলেন। আর ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম প্রধান এই দেশের সমাজহীন মুসলমান সমাজের নেতা-বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই অনেক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ক্রমে পরাধীন হয়েছেন। অনেকেই ক্রমে সুস্থ জীবনবোধও হারিয়েছেন।
তিন. ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানই মনে করতেন যে, তারা একই সমাজের মানুষ। যোগাযোগ যতই কম থাকুক বিশ্বের অন্যান্য এলাকার মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের একাত্মতাবোধ ছিল। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর কিছু নেতা-বুদ্ধিজীবীর ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের, অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের, কর্ম নিরপেক্ষতার এবং তথাকথিত আধুনিকতার আন্দোলনের প্রভাবে সেটা ক্রমে লোপ পায়। সেই শূন্যস্থান ক্রমে ক্রমে পূরণ করেছে হরেক রকমের স্লোগান, হরেক রকমের বাগাড়ম্বর, হরেক রকমের ভোগবাদ এবং হরেক রকমের ধান্দাবাজি এবং ধোঁকাবাজি। আমি নির্দিষ্টভাবে কোনো সরকার বা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কথা বলছি না। কেননা, এটাই বহুলাংশে হয়ে গেছে যেন একটা সাধারণ নিয়ম। এর বাইরে খুব কম মানুষ আছেন।
চার. ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বলতে ছিল কতকগুলো অধিকার পাওয়ার আকাক্সক্ষা। বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্যও অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সাংবিধানিক রক্ষা কবচই ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মূল দাবি। এসবই ছিল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এবং কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বাধীন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মূল দাবি। অবিভক্ত ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের কন্সটিটিউশনাল গ্যারান্টি বা সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পাওয়ার দাবিই ছিল ১৯৪৭-এর ২ জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন বাধ্য না করা পর্যন্ত, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মূল দাবি। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কোনো দিনই করেনি। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ করেছে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের রাজনীতি। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছিল, এটা অত্যন্ত ভিত্তিহীন কথা, বাজে কথা, অন্যায় কথা।
সাম্প্রদায়িক হতে গেলে কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে জাতীয়তাবাদী হয়ে সেই জনগোষ্ঠীকে অধিকার বঞ্চিত করতে হয়। সেই যোগ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশে অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র প্রধান সংখ্যালঘু মুসলমানদের থাকার কথা নয়। তৌহিদবাদে অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলমান হিসেবে কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে জাতীয়তাবাদী হয়ে সেই জনগোষ্ঠীকে অধিকার বঞ্চিত করে সাম্প্রদায়িক হওয়ার রুচি ও মানসিকতাও তখন মুসলমান হিসেবে মুসলমানদের ছিল না।
১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে যে বিভাজনটা ঘটানো হয়েছে সে রকম বিভাজন ঘটানোর আকাক্সক্ষা এবং যোগ্যতাও মুসলমানদের ছিল না। সেই আকাক্সক্ষা এবং যোগ্যতা যদি মুসলমানদের থাকত তাহলে মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত পাঞ্জাব, মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত হলে বাংলা এবং মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত আসাম ভাগ করে ব্রিটিশ ভারতের বিশ শতাংশ জায়গায়, ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশ জায়গায় একটা মুসলিমপ্রধান দেশ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতারা কার্যত প-িত জহরলাল নেহরুর পরামর্শক্রমে ভি পি মেনন প্রণীত লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্ল্যান পার্টিশন মেনে নিতে বাধ্য হতেন না।
লাহোর প্রস্তাবের কথা বলা হয়। কিন্তু যারা প্ল্যান পার্টিশন প্রণয়ন করেছিলেন লাহোর প্রস্তাব তাদের আলোচনায়ই আসেনি।
জাতীয়তাবাদী বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রী মনুসংহিতার সমাজের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভায় ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে অধিকার বঞ্চিত করার লক্ষ্যে যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে, ব্রিটিশ ভারতের মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনও খর্ব করতে পারবে, এটা জানার পর ১৯৪০-এর মার্চের ২২, ২৩ এবং ২৪ তারিখে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ২৭তম অধিবেশনে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সিমলায় প্ল্যান পার্টিশন প্রণয়ন করার সময় প-িত জহরলাল নেহরু, ভি পি মেনন, কৃষ্ণ মেনন ও লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মধ্যকার আলোচনায় এই লাহোর প্রস্তাবের কথা আসেনি। এরা যা ঠিক করেছিলেন তা এদের মাধ্যমে অন্য কংগ্রেস নেতারা জেনে শিখ নেতাদের জানাতেন। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতারা ২ জুন ১৯৪৭ তারিখে সকাল ১১টায় হিন্দু ও শিখ নেতাদের সঙ্গে লর্ড মাউন্ডব্যাটনের সামনে বসার আগে এ বিষয়ে অবহিত হওয়ার সুযোগ পাননি।
পাঁচ. ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের ইতিহাস তাদেরই লেখা উচিত, মজলুম মুসলমানদেরকে যারা জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন না কিংবা জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা লোকজনদেরকে খুশি করে যারা ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, আধুনিক, কমিউনিস্ট, সোস্যালিস্ট এসব সাজেন না।
ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের লেখা আমি এখন থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল আগে থেকেই পড়ি। ১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টের পর তিনি সে সময়কার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়েছিলেন। এ রকম একজন ব্যক্তি, যিনি এক সময় যুক্তরাজ্যে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তিনি ১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টের বিভাজনের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেননি এবং জানেননি, এমনটা বিশ্বাস করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কিন্তু ঢাকার দৈনিক কাগজ প্রথম আলোয় প্রকাশিত তার অনেক লেখায় দেখি, ১৯৪৭-এর বিভাজনের দায় তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ওপর চাপাচ্ছেন। ২৯ শে নভেম্বর ২০১৬ তারিখ মঙ্গলবার ঢাকার দৈনিক প্রথম আলো’য় ‘জনগণই জয়ী হবে’ শিরোনামে একটি লেখায় পাকিস্তানের “দ্য ডন” পত্রিকার প্রশংসা করতে গিয়েও তিনি লিখলেন যে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নাকি ‘নিজের পাকিস্তানের আদর্শ প্রচার জন্য’ নয়াদিল্লিতে এই ‘পত্রিকাটি খুলেছিলেন’।
পাকিস্তানটা মুসলমানরা করেছেন এই মিথ্যাটি প্রচার করে করে সবার মনে, বিশেষ করে মুসলমানদের মনে একটা অপরাধবোধ এবং হীনমন্যতা এনে দিয়ে এ জন্য মাসুল দেওয়ার জন্য তাদের মনটাকে প্রস্তুত করাটাই এই প্রচারের প্রধান লক্ষ্য।
আসলে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নয়াদিল্লিতে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের কথা এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কথাও জানানোর সুযোগ পাওয়ার সুবিধার্থে। নিজের পাকিস্তানের আদর্শ প্রচার করার জন্য নয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন জাতীয়তাবাদী বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রী মনুসংহিতার সমাজের ডান-বাম নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন করেছেন সে তথ্য আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ঐতিহাসিক আমলে ত্রিপাঠীর লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ শীর্ষক গ্রন্থে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কলকাতার দেশ পত্রিকার ‘কংগ্রেস শতবর্ষ সংখ্যায়’ ভারত বিভাগ/(কার্য ও কারণ) শিরোনামে অতুল্য ঘোষের নিবন্ধে; ঢাকার খোশরোজ কিতাবমহল থেকে প্রকাশিত আবুল কালাম শামসুদ্দীনের লেখা ‘অতীত দিনের স্মৃতি’ শিরোনামে গ্রন্থে; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হেক্টর বোলাইথোর লেখা ‘জিন্নাহ : ক্রিয়েটর অব পাকিস্তান’ শিরোনামে গ্রন্থে; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক স্ট্যানলি উলপার্টের গ্রন্থ ‘জিন্নাহ অব পাকিস্তান’-এ; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক স্ট্যানিল উলপার্টের লেখা ‘নেহরু : আ স্ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি’ শীর্ষক গ্রন্থে পাওয়া যাবে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিমিটেডের আরো বিভিন্ন সংখ্যা থেকে এবং অন্যান্য আরো অনেক সূত্র থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি। অন্যান্য বইপত্র থেকেও পেয়েছি। এসব প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও দেখছি, একটা মিথ্যার প্রচার চলছে। মুসলমানদের সমাজ নেই বলে এসব দেখারও কেউ কোথাও নেই।
ছয়. ১২ নভেম্বর ২০১৬ তারিখ শনিবারের ‘প্রথম আলো’য় ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উৎসের সন্ধানে’ শীর্ষক নিবন্ধে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিম-লীর সদস্য হায়দার আকবার খান রনো চরম অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে লিখেছেন :
‘১৯০৬ সালে একই বছর ব্রিটিশ শাসকদের সরাসরি মদদে সৃষ্টি হলো দুটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলÑ মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা। পাকিস্তান আন্দোলন ও ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের মদদে তৈরি হয়েছিল।... ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও সহযোগিতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল।”
আমি যে বইপত্রগুলোর কথা উল্লেখ করেছি সেগুলো পড়লেও তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, তার অজ্ঞতা তারই উল্লিখিত এসব বিষয়ে কত অপরিসীম। যেমন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ১০৯৬-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভা ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিটিশ উপনিবেশিক সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেস।
হায়দার আকবার খান রনো পঞ্জিকা দেখলে জানতে পারবেন যে, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট ছিল রোজার দিন, রমজান মাসের একটা তারিখ। কলকাতায় সে সময়ও মুসলমানরা ছিলেন হিন্দুদের তুলনায় অত্যন্ত সংখ্যালঘু। এই মুসলমানদের অধিকাংশই ছিলেন অশিক্ষিত এবং হতদরিদ্র। কলকাতায় তো বটেই, ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত মুসলিমপ্রধান বাংলার অন্যান্য শহরেও মুসলমানদের অবস্থা ছিল একই রকম। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্টের দুই দিন আগে থেকে কলকাতা পুলিশের হিন্দু ও শিখরা গণছুটি নিয়েছিলেন। হিন্দু গু-াদের সঙ্গে মিলে শিখরাও মুসলিম নিধনযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবিভক্ত মুসলিমপ্রধান বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত লাল বাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে এবং নিজে বিভিন্ন এলাকা সফর করে মুসলিম নিধনযজ্ঞ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে কোনো মুসলিম নিধনযজ্ঞের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। আর হায়দার আকবর খান রনো জেনে ফেলেছেন মুসলিম লীগই এসব করেছে। হায়দার আকবর খান রনো সাহেব পড়াশোনা করলে জানতে পারবেন যে, ১৭৫৭-র ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের কাল থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহযোগী সমাজ হিসেবে জাতীয়তাবাদী বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রী মনুসংহিতার সমাজ ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা একচেটিয়াভাবে পেয়ে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা একচেটিয়াভাবে পেয়ে সমস্ত ক্ষেত্রে এককভাবে এগিয়ে গেছেন। অন্যদিকে ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী খ্রিস্টান ইংরেজদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হয়ে মুসলমানরা হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন, অসংগঠিত, অপরিণামদর্শী লক্ষ্যভ্রষ্ট ও লক্ষ্যহীন একটা সমাজহীন সমাজে পরিণত হয়েছে।
সাত. এই স্বাধীনতা প্রসঙ্গেও সব সময়েই যে অভাবের কথাটা স্মরণে আসে সেটা এই যে, অন্তত বাংলাভাষী মুসলমানদের কোথাও কোনো সমাজ নেই। বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে যারা ধনী এবং যারা আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল তাদের অনেকেই মনে করেন যে, তারা একটা আলাদা সমাজের লোক। আর যারা গরিব এবং হতদরিদ্র মুসলমান তারা আরেকটা আলাদা সমাজের মানুষ। আসলে সমাজহীন মুসলমান সমাজের এই উভয় জনগোষ্ঠীর কারো চোখের সামনেই এখন আর মুসলমান সমাজ নেই। এদের উভয় অংশেরই অনেকেই কার্যত হয়ে গেছেন এক একটা (পলিটিক্যাল) পার্টি সমাজের লোক। ফলে সমাজহীন মুসলমান সমাজের হয়ে কাজ করার তেমন কেউ আর কোথাও নেই। ভাষা, অঞ্চল, দেশ নির্বিশেষে হিন্দুদের সবারই কিন্তু একটা অত্যন্ত সুসংঘবদ্ধ সমাজ আছে। তাই তাদের যথার্থ স্বাধীনতা আছে এবং তাদের সমাজের জন্য সমস্ত গঠনমূলক কাজই হয়। সমাজহীন মুসলমান সমাজের মুসলমানরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকে নিঃসঙ্গভাবে থেকে কোথায় কোন স্বাধীনতা ভোগ করবেন এবং কোথায় কোন স্বাধীনতাই বা রক্ষা করেন?
লেখক : নজরুল গবেষক ও ইতিহাসবিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন