বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

জাহাজ নির্মাণ শিল্পে সহায়তা প্রয়োজন

| প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর : অত্যন্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জাহাজ নির্মাণ শিল্প কিছুটা গতিহীন হয়ে পড়েছে এবং এই সেক্টরে কিছুটা স্থবিরতা নেমে এসেছে। ফলে জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে নিয়ে আমাদের যে বিশাল একটি স্বপ্ন, তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। জাহাজ নির্মাণ এবং জাহাজ রপ্তানির যে বিশাল সুযোগ আমাদের সামনে এসেছিল, তাকে আমরা যথাযথ কাজে লাগাতে পারিনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি কারণে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বর্তমানে মন্দাভাব চললেও অদূর ভবিষ্যতে এই সেক্টরে মন্দাভাব থাকবে না। ভবিষ্যতে এই সেক্টরে সুদিন আসবেই। কারণ বিশ^ বাণিজ্য পরিচালনার জন্য জাহাজ লাগবেই। সুতরাং নতুন জাহাজ নির্মাণ করতেই হবে। আর আমাদের জাহাজ নির্মাণ শিল্প তখন ঘুরে দাঁড়াবেই। সুতরাং আগামীর সুদিনকে কাজে লাগানোর জন্য আজকের দুর্দিনে টিকে থাকতে হবে। তার জন্য জাহাজ নির্মাণ শিল্পে সহায়তা করতে হবে। আর প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে জাহাজ নির্মাণ শিল্প যদি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এবং ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আর এই শিল্পকে দাঁড় করানো যাবে না। সুতরাং, সরকারের উচিত, জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে বাস্তবসম্মত সহায়তা দিয়ে এই সেক্টরকে টিকিয়ে রাখা। তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলছি, আপনারা জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রকৃত সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করুন এবং এর সমাধানে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আর এই সেক্টরটি টিকে থাকলে রপ্তানি ক্ষেত্রে আমাদের নতুন একটি ডাইমেনশন সৃষ্টি হবে, যা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে।
বাংলাদেশ এখন আর কেবল জাহাজ ভাঙ্গার দেশ নয়, বরং জাহাজ নির্মাণ এবং জাহাজ রপ্তানিরও দেশ। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ নির্মাণ করছে এবং তা বিশ^বাজারে রপ্তানি করছে। এর মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ নতুন পরিচিতি লাভ করেছে এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে নতুন একটি যাত্রা শুরু করেছে। জাহাজ নির্মাণ এবং রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ সাফল্যের নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য বিরাট একটি অর্জন। যেসব উদ্যোক্তা জাহাজ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে তাদের প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও সম্মান। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে সম্মান এবং গৌরবের নতুন এক পরিচয়। একই সাথে এনে দিয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। এই খাতের সাফল্য এ দেশের অর্থনীতিতে আনতে পারে দারুণ এক সফলতা। এর মাধ্যমে এদেশের দরিদ্র মানুষদের জীবনে আসতে পারে সুখ এবং স্বচ্ছলতা। তাই সফলতা এবং সম্ভাবনার যে পথে দেশ শুরু করেছে নতুন এক অভিযাত্রা, সে পথে এগিয়ে যেতে হবে আরো বহুদূর। এই খাতে আমাদেরকে সাফল্য অর্জন করতেই হবে। তাই এই শিল্পের সফলতার জন্য সরকারসহ সবাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িতে দিতে হবে।
এদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিগত কয়েক বছর থেকে এখাতে কাজ করে আসছে। ২০০৮ সালের ১৫ মে বাংলাদেশ প্রথম জাহাজ রপ্তানি করে। ওই দিন আনন্দ শিপইয়ার্ড এন্ড শিপওয়েজ নামের একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ করে সেই জাহাজ আনুষ্ঠানিকভাবে ডেনমার্কে রপ্তানি করে। ওই দিন নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটের আনন্দ শিপইয়ার্ড চত্বরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় তিন হাজার টন মালামাল বহনে সক্ষম স্টেলা ম্যারিস নামের একটি জাহাজ ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান স্টিলা শিপিংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ এবং জাহাজ রপ্তানি শুরু করে। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে জাহাজ নির্মাণ করছে এবং তা রপ্তানি করছে। বর্তমানে আনন্দ শিপইয়ার্ড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, খান ব্রাদার্স শিপ বিল্ডিং কোম্পানি, হাইস্পিড শিপইয়ার্ড, খুলনা শিপইয়ার্ড, মেঘনা শিপ বিল্ডার্স, কর্নফুলী শিপইয়ার্ড, এফএমসি শিপইয়ার্ড ও সিনহা শিপইয়ার্ড রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সাতটি দেশে জাহাজ রপ্তানি হচ্ছে। দেশগুলো হচ্ছে জার্মানি, ডেনমার্ক, তাঞ্জানিয়া, পাকিস্তান, ফিনল্যান্ড, ইকুয়েডর ও জাম্বিয়া। সম্প্রীতি ভারতের জিন্দাল গ্রুপ জাহাজ নির্মাণের জন্য ওয়েস্টার্ন মেরিনের সাথে চুক্তি করেছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের সফলতা, দক্ষতা এবং নির্ভরতার প্রতীক। গধফব রহ ইধহমষধফবংয খোদাই করা জাহাজ বিশ্বের এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে ঘুরে বেড়াবেÑ এ স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের বিরাট অর্জন। আর এ অর্জনকে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে।
জাহাজ নির্মাণ নিঃসন্দেহে একটি বিশাল ব্যাপার। জাহাজ নির্মাণে যেমন প্রয়োজন উঁচুমানের কারিগরি দক্ষতা, ঠিক তেমনি প্রয়োজন উন্নত এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা। তাছাড়া প্রয়োজন বিরাট অংকের বিনিয়োগ। বর্তমানে ছোট আকারের একটি জাহাজ নির্মাণ করতেও প্রায় ২৫/৩০ কোটি টাকা প্রয়োজন। আর বড় আকারের জাহাজ নির্মাণে প্রয়োজন শত কোটি টাকা। সময় লাগে প্রায় দেড় থেকে দুই বছর। এখনো বিশ^ব্যাপী আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের ৯৯ শতাংশই জলপথে সম্পন্ন হয়, যার বাহন হচ্ছে এই জাহাজ। আন্তর্জাতিক পরিম-লে জাহাজ নির্মাণে বর্তমানে বছরে প্রায় ৪০০ (চারশত) বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। আর এটা প্রতিবছর প্রায় ৬% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি এই ৪০০ (চারশত) বিলিয়ন ডলারের ১% কাজও করতে পারে, তাহলে তার পরিমাণ হচ্ছে ৪ (চার) বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৪০০ (চারশত) কোটি ডলার। ১ মার্কিন ডলারের বাংলাদেশি টাকায় গড় মূল্য যদি ৭৫ টাকা ধরি, তাহলে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মূল্য হচ্ছে ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) কোটি টাকা। আর যদি ২% কাজ করতে পারে তাহলে তার পরিমাণ হচ্ছে ৮ (আট) বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৮০০ (আটশত) কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মূল্য হচ্ছে ৬০০০০ (ষাট হাজার) কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে এসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের মহাসচিব এবং ওয়েস্টার্ন মেরিন গ্রপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশল মো. শাখাওয়াত হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, যথাযথ সরকারি সহায়তা পেলে জাহাজ নির্মাণ শিল্প খাত থেকে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মূল্য হচ্ছে ১৫০০০০ (এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) কোটি টাকা। আমিও মনে করি, এটা সম্ভব।
তবে তার জন্য সরকারকে এই শিল্পের প্রতি সর্বাত্মকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এই শিল্পের বিকাশে বিদ্যমান সকল প্রতিকূলতাকে দূর করতে হবে। এই শিল্পে ইনসেনটিভ দিতে হবে এবং এর অগ্রগতির জন্য বিশেষ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নগদ সহায়তার পরিমাণ ১৫% করা হোক। এই সেক্টরের জন্য পাঁচ হাজার কোটির টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করা হোক এবং কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হোক। ব্যাংকের পাশাপাশি ইন্স্যুরেন্স, কাস্টম এবং বন্দরসহ সকলকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আজ জাহাজ রপ্তানির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর তীরগুলোতে জাহাজ নির্মাণের জন্য অসংখ্য শিপইয়ার্ড গড়ে তোলার বিরাট সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে এমনকি বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত আনোয়ারা এবং বাঁশখালীতেও জাহাজ নির্মাণের জন্য বড় আকারের শিপইয়ার্ড গড়ে তোলার বিরাট সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিদেরকেও জাহাজ নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে জাহাজ নির্মাণে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ বিদেশি উদ্যোক্তাদের সাথে নিয়ে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অধিকন্তু বাংলাদেশের ব্যাপক সংখ্যক যুবসমাজকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই শিল্পের জন্য দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব। ভৌগোলিক অবস্থান, বন্দর এবং ব্যাপক সংখ্যক নদীর উপস্থিতি ও শ্রমের সহজ লভ্যতার কারণে বাংলাদেশ খুব সহজেই এই শিল্পে সফলতা অর্জন করতে পারে। বাংলাদেশ নদীমার্তৃক দেশ হবার কারণে নদী পথে পণ্য পরিবহনের বিশাল একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। এছাড়া নদী পথে ব্যাপক সংখ্যক মানুষও যাতায়াত করে। নদী এবং সাগর থেকে মাছ ধরার জন্য নিয়োজিত রয়েছে হাজারো মাছ ধরার জাহাজ। পণ্য পরিবহন, মানুষ পরিবহন এবং মাছ ধরার জন্য দেশের অভ্যন্তরে ছোট, বড় এবং মাঝারি সাইজের যে বিরাটসংখ্যক লঞ্চ, কার্গো, স্টিমার এবং ফিশিং ট্রলার প্রয়োজন তার সবই যদি বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ কোম্পানিসমূহ নির্মাণ করে, তাহলেও তা অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। তাছাড়া সাশ্রয় হবে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। আর নদীপথে যাতায়াত বাড়লে সড়ক পথে চাপ কমবে। ফলে যানজট কমবে এবং মানুষের জীবন সহজ হবে। তাছাড়া এই শিল্পের বিকাশ হলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরো অনেকগুলো ব্যাকওয়ার্ড শিল্প গড়ে উঠবে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে। সুতরাং আমাদের কারো অবহেলা এবং অসহযোগিতার কারণে সম্ভাবনাময় এই শিল্পটা যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়, সেই বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদেরকে আশাবাদী হতে হবে এবং হাজারো প্রতিকূলকতাকে মোকাবেলা করে সফলতা এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হবে। তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারে এবং শিল্পায়নের প্রতিটি সেক্টরে সফলতা অর্জনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। ষোল কোটি মানুষের এই দেশকে এগিয়ে নিতে হলে একটি ভিশন এবং মিশন নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের সবার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই এবং এ ব্যাপারে আমি দৃঢ় আশাবাদী। স্বাধীনতার ৪৫টি বছর পূর্ণ হলেও আমরা এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭১ সাল থেকেই আমরা নি¤œ আয়ের দেশ ছিলাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-২০১৫ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলারে উন্নিত হয়েছে। নি¤œ আয়ের দেশের সীমারেখা ১০৪৫ ডলার অতিক্রম করায় আমরা এখন নি¤œমধ্যম আয়ের দেশ। বর্তমানে মাথা পিছু আয় বেড়ে ১৪৬৫ ডলারে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নের এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে সর্বদা অগ্রসরমান হতে হবে। তার জন্য শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। শ্রমের মূল্য ও শ্রমের সহজলভ্যতার কারণে এদেশে ব্যাপক হারে শিল্পায়ন সম্ভব। বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ বেশি বিধায় আমাদেরকে রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে জাহাজ নির্মাণ শিল্প হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর। আর তাই জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে সহযোগিতা করাটা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন