মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে ১৫ বছরের কম বয়সী একটি কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয় ১০ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের অনেক বেশি বয়সী পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ভারত, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিয়ের ঘটনা ঘটে। তবে ভারতে এ হার সবচেয়ে বেশি। কন্যাশিশুর বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম একটি। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়। ইউনিসেফের মতে বর্তমানে বিশ্বে ৭০ কোটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ৯৫ কোটিতে পৌঁছতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন, এর ফলে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যার প্রকট বাড়ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত¡া হচ্ছে। বাল্যবিবাহ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বির্তক রয়েছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে আমাদের মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে।
বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে মানুষ অনেক বেশি সচেতন। তারপরও দেশ থেকে এই ব্যাধি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্য বিবাহের হারের লজ্জা বাংলাদেশের। খবরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে প্রতি তিনটি বিয়ের দুটিতেই কনের বিয়ের বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার সর্বোচ্চ। শিশুদের জীবনমানের উন্নয়ন ভবিষ্যৎকে বদলে দেয়া শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। এ কথা ঠিক বাল্যবিয়ের ফলে কন্যাশিশুরা শিক্ষা, উন্নয়ন ও শিশু হিসেবে বড় হওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদি বলা হয়- ক্যান্সার, হৃদরোগ বা অন্যান্য জটিল ও প্রাণঘাতী রোগের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর বাল্যবিয়ে, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রাণঘাতী রোগে একজন আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি হয়। কিন্তু বাল্যবিয়ে একটা মেয়ে ও তার প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেয়। স্বাধীন সত্তা হিসেবে একজন বালেগা মুসলিম নারী যে কোনো মুসলিম পুরুষের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। অভিভাবক তাকে জোরপূর্বক বিবাহ দিলে তা কার্যকর হবে না। একবার এক যুবতী নারী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করলো যে, তার পিতা তাকে তার অসম্মতিতে বিবাহ দিয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উক্ত বিবাহ ভেঙে দেয়ার এখতিয়ার প্রদান করেন (আবু দাউদ) এমনকি কোনো মেয়েকে নাবালেগ অবস্থায় তার অভিভাবক বিবাহ দিলে সে বালেগ হওয়ার পর উক্ত বিবাহ বহাল অথবা বাতিলের এখতিয়ার লাভ করে। এটা ইসলামী আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা এবং সব মাযহাব এই বিষয়ে একমত (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ধারা নং ৩১৬-৩২১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা)
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪-এর খসড়া। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ এবং পুরুষের জন্য ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯২৯ সাল থেকে আইনিভাবে আগের বয়সসীমা ২১/১৮ চালু আছে। সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধের নামে এই আইন পাস করার পথে হাঁটলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এর ফলে বাল্যবিবাহ আইনগত ভিত্তি পেতে যাচ্ছে। মেয়েদের বয়স কমিয়ে আনার বিষয়টি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কেননা মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ করাটা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ। প্রচলিত আইন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বাল্যবিয়ে সমাজে যে রীতি চালু রয়েছে যতটা না আইনের কারণে, তার চেয়ে বেশি প্রয়োগের অভাবে। নারী-পুরুষ মিলেই তো একটি পরিবার। ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশে বিয়ের গড় বয়স ১৫.৮ বছর। আগের তুলনায় এটা কমেছে। কিন্তু এখনও ১৩-১৪ বছর বয়সেও অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। দরিদ্র বাবা-মা মনে করছে বিয়ে দিলেই মেয়ে ভালো থাকবে। আর্থ-সামাজিক নানা কারণেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হয়। বাল্যবিয়ের প্রধান কুফল হচ্ছে অল্প বয়সেই তারা সন্তানের মা হয়। আবার অনেক পরিবারে দেখা গেছে নববধূ বছর ঘুরতেই মা না হলে তার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শেষ থাকে না। নিকট অতীতে বাল্যবিয়ের প্রতিবাদে প্রাণ দিয়েছে কুড়িগ্রামের রিমা। জোর করে বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে রিমা আক্তার নামের ৭ম শ্রেণির এক মেধাবী ছাত্রী। বিয়েতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না রিমা। এ অবস্থায় রিমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় তার বাবা। এতে অভিমান করে রিমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
বিয়ের উপযুক্ত বয়স কোনটি? এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ একজন বালক ও বালিকার শারীরিক গঠন, স্থান, কাল ও পরিবেশভেদের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের একজন বালিকা যে বয়সে বিয়ের উপযুক্ত মনে করা হয় সেটা হয়তবা অন্য কোনো দেশে তারও আগে হতে পারে। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ কখনও ফরজ, কখনও ওয়াজিব, কখনও সুন্নাত আবার কখনো হারাম তথা নিষিদ্ধ। অতএব সোনা, রুপা ও লোহা এক পাল্লায় ওজন করা হবে হঠকারী সিদ্ধান্ত। বিয়ের উপযুক্ত বয়সের সময়টা ভালো বুঝতে পারে ব্যক্তি নিজেই। তবে অভিভাবকদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ অভিভাবকরা তো এ সময়টা পার করেই বুড়ো হয়েছেন। অভিভাবকদের মনে রাখা দরকার অবিবাহিত ছেলেমেয়ে যদি অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হয়, তখন তার দায়ভার কিন্তু পিতা-মাতার ওপর বর্তায়। ছেলেমেয়েদের অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার অভিশাপের হাত থেকে রক্ষা করতে বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্যই মহান রাব্বুল আলামিন বিবাহের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। বর্তমান আইনে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ সাজা তিন মাস এবং জরিমানা এক হাজার টাকা। কিন্তু এর বাস্তবায়ন খুবই কম। যে কারণে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বাল্যবিয়ে রোধ সম্ভব হচ্ছে না। শুধু আইন করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। উত্তরণের জন্য প্রয়োজন অভিভাবকের সচেতনতা ও আইনের শাসন। যে বয়সে একটি মেয়েশিশুর খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মানসিক পরিপক্বতা না আসার কারণে তার পক্ষে অন্য সংসারে গিয়ে মানিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় নির্যাতন। আবার এও দেখা গেছে যে শারীরিক পরিপক্বতা আসার আগেই সন্তান ধারণা করার ফলে মেয়েটির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। একজন অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকে এ ধরনের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া কখনই কাম্য হতে পারে না। অথচ যুগের পর যুগ আমাদের সমাজে তা-ই হয়ে আসছে। আমরা আশা করি প্রশাসন ও স্থানীয় সচেতন মহলের মিলিত প্রয়াসে এই অভিশাপ থেকে আমাদের মেয়েরা মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেককে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে বিবাহ করার মাধ্যমে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের তাওফিক দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন