রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে শিক্ষার পরিবেশ নষ্টের আশঙ্কা

বাইপাস সড়ক নির্মাণে পৌনে ২শ’ কোটি টাকার প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ

| প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবদুল ওয়াজেদ কচি, সাতক্ষীরা থেকে : সাতক্ষীরা বাইপাস সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তুঘলকি কারবার। প্রভাবশালীদের দখল করা সরকারি খাস ও অর্পিত সম্পত্তি রক্ষা করতে বাইপাস সড়ক আলিপুর চেকপোস্ট থেকে সরিয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেলের বুকের মধ্যে টেনে তোলা হয়েছে। একই সাথে সাতক্ষীরা মেডিকেলের ১০০ গজের মধ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে ট্রাক টার্মিনাল। এর ফলে ভবিষ্যতে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে বাইপাস নির্মাণ করা হচ্ছে সেটাও ব্যাহত হতে পারে। নির্মিত বাইপাস গুরুত্বহীন হয়ে পুনরায় আর একটি বাইপাস সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন হতে পারে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় না রেখে এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক গুরুত্বহীন এবং অপরের স্বার্থরক্ষার প্রকল্পে সরকারি পৌনে দুইশত কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই সাতক্ষীরার সচেতন নাগরিকরা বাইপাসের সংযোগস্থলটি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের মধ্যে না নিয়ে মেডিকেলের পিছন দিয়ে আলিপুর চেকপোস্ট পর্যন্ত সম্প্রসারণের দাবি জানিয়েছেন। শহরের যানজট নিরসনে বাইপাস সড়ক নির্মাণের দাবি উঠতে থাকে ৯০এর দশকের প্রথম দিকে। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি এবং বিভিন্ন সময়ে সাতক্ষীরার উন্নয়নে গঠিত বিভিন্ন নামের সংগঠন এই দাবি জানাতে থাকে। এক পর্যায়ে শহরে যানজট বাড়তে থাকায় এবং ১৯৯৬ সালে ভোমরা স্থলবন্দর চালু হওয়ার পর বাইপাস নির্মাণের এই দাবি আরো জোরালো হয়ে উঠে। এর প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২৩ জুলাই শ্যামনগরে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরায় বাইপাস সড়ক নির্মাণের ঘোষণা দেন। এর কিছুদিন পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেকে ভোমরা স্থলবন্দর সড়ক হতে বিনেরপোতা পর্যন্ত ২২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাইপাস সড়কের জন্য ১১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেটি সংশোধন করা হয় এবং ১৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে লাবসা পলিটেনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন সড়ক হয়ে বিনেরপোতা বিসিক শিল্প নগরী পর্যন্ত ১২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার বাইপাস সড়ক নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। ইতোমধ্যে উক্ত প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সাতক্ষীরা ১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান স¤প্রতি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনায় জানান, ভোমরা স্থলবন্দর সড়কের সাথে যুক্ত করেই বাইপাস সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কারণ জেলা পর্যায়ের সড়কে বাইপাসের জন্য এত বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ ছিল। তাই বাইপাস সড়ক ভোমরা স্থলবন্দর জাতীয় মহাসড়ক হওয়ায় তার সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। তিনি বলেন, টাকা পাওয়া যাবে কি যাবে না সেটা মাথায় রেখেই ভোমরা স্থলবন্দরের বিষয়টি হাইলাইট করা হয়। কিন্তু কিভাবে সেই সড়ক আলিপুর চেকপোস্টের পরিবর্তে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের মধ্যে এলো সেটা বোধগম্য নয়। সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী সাতক্ষীরা ৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. আ ফ ম রুহুল হক গত ৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এক সংবর্ধনা সভায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের বুক চিরে বাইপাস সড়ক নির্মাণের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি ঐ সভায় বলেন, আমাদের দোষ রয়েছে। আমরা জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যম কর্মীরা খেয়াল করিনি বাইপাস সড়ক কোন এলাকা দিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পূর্বে আমি ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মাটি ফেলার কাজ দেখে ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কথা বলে জানতে পারি ২০১০ সালেই বাইপাসের এ নকশা করা হয়েছে। তখন জানতে পারলে আমি যেভাবেই হোক এটা বন্ধ করতাম। জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক মো. আনিছুর রহিম বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে সাতক্ষীরাবাসী বাইপাস সড়কের জন্য আন্দোলন করে আসছি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরায় এসে বাইপাস সড়ক নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকাতায় ২০১০ জেলা প্রশাসনের সভায় এবিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী আলিপুর চেকপোস্ট এলাকা থেকে সড়কটি মেডিকেল কলেজ ও সিটি কলেজের পেছন দিয়ে কাশেমপুর গ্রাম হয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন সড়কে গিয়ে মিশে যাবে। সেখান থেকে মুথরাপুর মোড় হয়ে খেজুরডাঙ্গি হয়ে বিনেরপোতা মেঘনা মোড়ে গিয়ে খুলনার সড়কের সাথে মিশে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের সামনের লেক থেকে কাজ শুরু হয়েছে। এই বাইপাস জেলাবাসীর কোন উপকারে আসবে না। এতে করে মেডিকেল কলেজে শিক্ষা ও চিকিৎসার পরিবেশ নষ্ট হবে। জনবহুল ঐ এলাকায় বাড়বে সড়ক দুর্ঘটনা। ছাত্র ও শ্রমিকদের মধ্যে দ্ব›দ্ব সংঘাতেরও সৃষ্টি হবে। তাছাড়া মেডিকেল কলেজের একেবারে মধ্যখানে কীভাবে একটি মহাসড়কের সংযোগ হয় সেটি তার বোধগম্য নয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, আলিপুরের আব্দুস সবুরের দখলকৃত সরকারি খাস ও অর্পিত সম্পত্তি রক্ষায় বাইপাস ঘুরানো হয়েছে। কারণ বাকাল ব্রিজের পশ্চিম পাশের বিস্তীর্ণ এলাকার প্রায় হাজার বিঘা খাস ও অর্পিত সম্পত্তি এখন সবুর দখল করে। বাইপাস আলিপুর চেকপোস্টে নিতে হলে ঐ জমি হুকুম দখল করতে হতো। সেটা না করার জন্য কৌশলে বাইপাস ঘুরানো হয়েছে। তিনি বর্তমানে মেডিকেলের মধ্যে যেটি হচ্ছে সেটিকে মূল বাইপাসের একটি লিংক রোড করে মেডিকেলের পিছন দিয়ে আলিপুর চেকপোস্ট পর্যন্ত বাইপাস সম্প্রসারণের দাবি জানান। সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব ও গণফোরাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী নুর খান বাবুল বলেন, কয়েকজন ব্যক্তির স্বার্থরক্ষা করার জন্য বাইপাস সড়কের মূল নকশা বাদ দিয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা মেডিকেলের মধ্যদিয়ে বাইপাস সড়কের নকশা তৈরি করেছেন। অবিলম্বে আলিপুর চেকপোস্ট পর্যন্ত বাইপাস সড়ক স¤প্রাসারণ করার দাবি জানান তিনি। সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা শহর বাইপাস সড়ক নির্মাণে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে একনেকের বৈঠকে ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। গত ৩১ মার্চ সাতক্ষীরা-২ আসনের এমপি মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি’র উদ্বোধনের মাধ্যমে মূল সড়কের মাটির কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয়। সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনজুরুল কবির জানান, ২২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ বাইপাস সড়কের জন্য ১১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রকল্পের বাইরে আলিপুর চেকপোস্ট থেকে ভোমরা স্থলবন্দর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দুই লেনের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের ভোমরা সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। ৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাইপাসের ১২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে পলাশপোল, কাশিমপুর, বাবুলিয়া, বাঁশঘাটা, লাবসা, মথুরাপুর, বিনোরপোতা এই ৮টি মৌজা ৯২ দশমিক ৫৮ একর জমি ইতিমধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের সূত্র আরো জানায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে একটি সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। যেখানে ১২ দশমিক ৩৫০ কিলোমিটার দুই লেনের (২৪ ফুট চওড়া) সড়কের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১৭৪ কোটি টাকা। কিন্তু একনেকে ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। সড়কটি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের লেক থেকে শুরু হয়ে সিটি কলেজের পিছন হয়ে কাশেমপুর গ্রাম দিয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন যশোর সড়কে গিয়ে মিশে যাবে। সেখান থেকে মুথরাপুর মোড় হয়ে খেজুরডাঙ্গি হয়ে বিনেরপোতা মেঘনা মোড়ে গিয়ে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের সাথে মিশে যাবে। আর এ সড়ক নির্মাণ করার জন্য ৯২ দশমিক ৫৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। একটি স্বার্থন্বেষী মহলকে খুশি করতে ভোমরা স্থলবন্দরের মূল সড়ককে পাশ কাটিয়ে বাইপাস আলিপুর চেকপোস্টের পরিবর্তে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের মাঝখানে যুক্ত করা হয়েছে এই অভিযোগ সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনজুরুল কবির অস্বীকার করেন। তিনি বলেন এই প্রকল্পের ডিজাইন ও বাজেট আমার আগের নির্বাহী প্রকৌশলীর সময়ে হয়েছে। বিষয়টি আমিও শুনেছি। তবে এটি সত্য নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন