মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : নবী করীম (সা.) এর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হয় তাতেই পড়া ও লেখার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। সেখানে কলমের উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলা হয়েছে যে, কলম হলো মানুষের জ্ঞান ভান্ডারের নির্ভরযোগ্য হিফাজতকারী। নবী করীম (সা.)-এর জীবনকালেই মুসলমানগণের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে চিন্তার উন্মেষ ঘটে। পরবর্তীকালে এর উপর ভিত্তি করেই বিকশিত হয় বিভিন্ন বিজ্ঞানের। এর মধ্যে রয়েছে কালাম শাস্ত্র ও তাসাওউফ বিজ্ঞান। মুসলমান বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিভাবান দার্শনিক জন্ম নেন। এদের মধ্যে ছিলেন আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইব্ন সিনা, ইব্ন রুশ্দ প্রমুখ। তাঁদের মৌলিক দর্শন ও পাÐিত্যে ইল্ম, কালাম ও তাসাওউফ বিজ্ঞান আরো সমৃদ্ধ হয়।
মুসলমানগণই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। প্রাচীনকালেও আইনের প্রচলন ছিল। ক্ষেত্র বিশেষে এগুলো বিন্যস্ত থাকলেও সেসব আইনের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। সে সময়ে আইনের দর্শন ও আইনের উৎস সম্পর্কে কোনো আলোচনা হতো না। আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, প্রয়োগ-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে কোনো আলোচনা হতো না। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের আগে এ বিষয়গুলো আইন বিশারদদের বিন্দুমাত্র নাড়া দিত না। মুসলমানগণ আইনের উৎস কুরআন ও হাদিসের আলোকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন সম্পর্কে ব্যাপক চর্চা শুরু করেন। তাঁরাই সর্বপ্রথম আইনকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন।
মুসলমানগণ সর্বপ্রথম আইনকে একটি নির্দিষ্ট বিধি ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসেন, এর সঙ্গে জুড়ে দেন দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়টি। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের ইতিহাসের শুরুতে যে সমস্ত চুক্তিপত্র বা আইন প্রণীত হয়েছে, সেগুলোতেও আন্তর্জাতিক ধারাসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। বস্তুত, মুসলমানদের হাতে আন্তর্জাতিক আইন স্বতন্ত্র শাস্ত্র বা বিজ্ঞান হিসেবে বিকাশ লাভ করে। ইব্ন হাজর রচিত ‘তাওয়ালী আত-তাসীস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে পথম গ্রন্থ রচনা করেন হযরত ইমাম আবু হানীফা (র.)। তিনি ছিলেন জায়েদ ইব্ন আলী সমসাময়িক। এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে- ক) এখানে সমস্ত বিদেশীকে একই পাল্লায় পরিমাপ করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে কোন রকম তারতম্য বা কারো প্রতি কোনরকম পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি। খ) মুসলমানদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়ে এখানে কোন উল্লেখ নেই বরং গোটা বিশ্বের অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এ গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বিষয়।
মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অবদান রয়েছে তুলনামুলক কেইস ল-এর ক্ষেত্রে। ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বিশেষ কোন আইনের ব্যাপারে কেন এ মতপার্থক্য দেখা দেয় অথবা এ জাতীয় মতপার্থক্যের ফলাফল কি হতে পারে তা নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। এখান থেকেই তুলনামূলক কেইস ল-এর উদ্ভব ঘটে। এ বিষয়ের উপর দাবসী এবং ইব্ন রুশদ রচিত পুস্তকগুলো পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। সাইমুরী তুলনামূলক আইন বিজ্ঞান বা আইন পদ্ধতির উপর পুস্তক রচনা করেন।
ইসলাম মানুষের জীবনকে দেখে সামগ্রিকভাবে। এখানে মসজিদ ও দুর্গের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এখানে রাষ্ট্রে বিধিবিধান বা সংবিধানের ধারাগুলো বিবেচিত হয় ধর্মীয় বিধি-নিষেধের অংশ হিসাবে। কারণ এখানে যিনি রাষ্ট্রের প্রধান, তিনিই ধর্মীয় নেতা ও মসজিদের ইমাম। আবার সরকারের রাজস্ব ও অর্থ ব্যবস্থাকে গণ্য করা হয় ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। কারণ, নবী করীম (সা.)-এর ঘোষণা অনুসারে সালাত, ইসলাম ও হজ্জের মতো এটাও (যাকাত) ইসলামের একটি স্তম্ভ। অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক আইন দÐবিধির একটি অংশ। আর লুটতরাজ, ডাকাতি, রাহাজানি, আইন বা চুক্তি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থাকে গণ্য করা হয় জেহাদের মর্যাদায়।
ইতিহাস এবং সমাজ বিদ্যায় মুসলমানদের অবদান প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে (ক) তথ্য নির্ভর এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, (খ) নানান প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিচিত্র ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। ইসলামের ইতিহাস অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। এখানে পৌরাণিক কাহিনী বা কল্পলোকের কোন স্থান নেই। ইসলামের ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সূ² ও যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন