শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

সুন্দরবন এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন করা যাবে না

| প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সুন্দরবনের আশপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে উক্ত এলাকাজুড়ে শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন কেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্টের প্রজ্ঞাপনের লঙ্ঘন বলে ঘোষণা করা হবে না এবং নতুন শিল্পকারখানা কেন বন্ধ করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে রুলসহ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে সেখানে কতটি শিল্পকারখানা রয়েছে, এর তালিকা ছয় মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সম্প্রতি সরকার বিদ্যমান শিল্পকারখানার পাশাপাশি নতুন করে ১৬টি শিল্পকারখানাকে অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে ৮টি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বোতলজাত করার কারখানা, যা মারাত্মক দূষণকারী বা লাল তালিকাভূক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাকি ৮টি বড় ও মাঝারি আকৃতির শিল্পকারখানা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশিত হলে রিট আবেদন করেন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের সভাপতি। 

পরিবেশবিদ ও সুন্দরবন রক্ষায় সচেতন শ্রেণীর মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র সুরক্ষায় বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। আমরা লক্ষ্য করছি, প্রকৃতির এক অপার আশ্চর্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতি হয় এমন কার্যক্রম সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চলছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সরকারের তরফ থেকেও এ বনের ক্ষতি হয় এমন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা যাবে না বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, সেই সরকারই নতুন করে শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী ছাড়া কিছু বলা যায় না। পরিবেশবিদরা এ কথা বহুবার বলেছেন, শিল্পকারখানা হারিয়ে গেলে তা অন্য জায়গায় গড়ে তোলা সম্ভব। সুন্দরবন হারিয়ে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। চিরায়ত এ সত্য কথাটি সরকার উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। বনের ক্ষতি হয় এমন কর্মকাÐ অব্যাহত রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে অনেক গবেষণামূলক তথ্য-উপাত্তের কথা জেনেছি। সরকারও তার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেছে এতে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। এর জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে, এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কলকারখানা স্থাপন করলে তাতে দুর্ঘটনা ঘটবে না এ গ্যারান্টি কখনোই দেয়া যায় না। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেও দুর্ঘটনা ঘটে পরিবেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। আমাদের মতো দেশে দুর্ঘটনা ঘটলে তা যে অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনবে, তাতে সন্দেহ নেই। এ ক্ষতি পোষানোর কোনো উপায়ই থাকবে না। আমরা দেখেছি, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যালা নদীতে অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজ ডুবিতে সুন্দরবনের গাছ-গাছালি, মৎস ও প্রাণীজ সম্পদ কী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন উপায়ে এর ক্ষতি সাধন তো হচ্ছেই। সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিয়ে শুধু যে দেশের পরিবেশবিদরা উদ্বিগ্ন তা নয়, জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, এর অমূল্য ও বিরল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট, যা বিশ্বে খুব কম দেশেই রয়েছে, এর ক্ষতি হওয়া। ফলে এ বনের ক্ষতিকারক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য তারা সরকারকে বারবার আহŸান জানিয়েছে। এটা অচিন্তনীয় ব্যাপার যে, সুন্দরবনের আশপাশ ঘিরে প্রায় ৩২০টি শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৬টি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার আগেই স্থাপন করা হয়েছে। এসব শিল্পকারখানার মধ্যে মারাত্মক দূষণকারী বা লাল চিহ্নিত কারখানা রয়েছে। নতুন করে যদি আরও শিল্পকারখানা গড়ে তোলার অনুমোদন দেয়া হয়, তবে সুন্দরবনের কী ভয়ংকর ক্ষতি হবে, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ রাখে না। এসব শিল্পকারখানা নিশ্চিতভাবেই সুন্দরবনকে মারার ফাঁস হয়ে থাকবে।
সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব মূলত সরকার ও তার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। এর কোনো রূপ ক্ষতি হয়, এমন অপকর্ম বন্ধ করার দায়িত্বও সরকারের। আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাচ্ছি। সরকার সুন্দরবনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার পরিবর্তে উল্টো ক্ষতি হয় এমন কর্মকাÐ অনুমোদন করছে। এটা অনেকটা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো। সরকারের এই অনাকাক্সিক্ষত অনুমোদন ঠেকাতে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার মতো উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। বোধগম্য হচ্ছে না, সুন্দরবনের ক্ষতি হয়, এমন উদ্যোগ সরকার কেন নিচ্ছে। দেশে কলকারখানা স্থাপন অবশ্যই করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য তা অপরিহার্য। তার অর্থ তো এটা হতে পারে না, অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা আরেকটি অমূল্য সম্পদের ক্ষতি করে তা করতে হবে। এটা সবার জানা, সুন্দরবন শুধু প্রাকৃতিক ঐতিহ্যই নয়, এর থেকে আহরিত সম্পদের উপর অসংখ্য মানুষ নির্ভরশীল। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এটি ভয়াবহ ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে উপকূলীয় এলাকার রক্ষাকবচ। ইতোমধ্যে আইলা, সিডরের মতো প্রলংকরী ঝড় সুন্দরবন বহুলাংশে রুখে দিয়েছে। আমাদের কথা স্পষ্ট, সুন্দরবনের ক্ষতি হয় এমন কলকারখানা তার চারপাশের এলাকায় গড়ে তোলা যাবে না। শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হলে দেশের অন্যান্য সুবিধাজনক এলাকায় গড়ে তুলতে হবে। সুন্দরবনের ক্ষতি হয়, এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন