শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের হাত থেকে বাঁচাতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

স্বনামখ্যাত অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, রাজনীতি এখন ব্যবসার সম্প্রসারিত অংশ আর টাকা নির্বাচনে জেতার পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলগুলোর ভিতরে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রবেশ করছে। ফলে রাজনীতি ধনীদের খেলায় পরিণত হয়েছে।
রাজনীতি সম্পর্কে এ প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদের মূল্যায়ন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনীতি হলো রাষ্ট্রপরিচালনায় বিজ্ঞান। দেশ ও জাতির সেবায় যারা নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতি তাদের পাথেয় বলে বিবেচিত। ১৬ কোটি মানুষের এ জাতির সব মহৎ অর্জন এসেছে রাজনীতিকদের হাত ধরে। বাঙালির হাজার বছরের সেরা অর্জন স্বাধীনতার পথ রচনা করেছেন রাজনীতিকরা। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো ত্যাগী নেতারা এদেশের রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মুনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের মতো ত্যাগী নেতাদের কারণে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালিদের আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের আজকের সব অর্জনের পেছনেও এসব নেতার অবদান অনস্বীকার্য।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, যে রাজনীতি ছিল দেশ সেবার মাধ্যম তা আজ রাতারাতি অর্থ অর্জনের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে ক্ষয় করছে। অর্থ ও পেশিশক্তির কুশলীবরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখলের সুযোগ পাওয়ায় দলগুলোতে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন জাতির জন্য নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সুশাসনের ব্যত্যয় ঘটছে। ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাটের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে আরেক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেছেন, সঠিক অডিট হলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে। ব্যাংকে জনগণের টাকা গচ্ছিত থাকে। সে অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত ঋণের আবরণে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুধু সুশাসনের ব্যত্যয় নয়, দেশের অর্থনীতিকেও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অস্তিত্বের স্বার্থেই রাজনীতিকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে উদ্যোগী হতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনীতিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে অনৈতিক পেশায় পরিণত হয়েছে রাজনীতি। একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিবিদরা গৌরবের সঙ্গে পেশা হিসেবে পরিচয় দিতেন রাজনীতি। এখন অনেকটাই বদলে গেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের এমপির ৭০ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী। একসময়কার অনেক পেশাদার রাজনীতিবিদও সরাসরি বিভিন্নভাবে ব্যবসা করছেন। আবার নামে-বেনামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তারা ব্যবসায় সম্পৃক্ত আছেন। মাঠ থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একই অবস্থা। এমনকি ডান-বাম সব ধরনের নেতাই ঝুঁকছেন ব্যবসার দিকে। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলে যোগ দিচ্ছেন ব্যবসার জন্যই। ছাত্র-যুব সকল পর্যায়ের রাজনীতিতে একই চিত্র। আবার এমপি হওয়ার পরই পাল্টে গেছে কারও কারও পেশাও। আগে ব্যবসা না করলেও এমপি হয়েই জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসার সঙ্গে। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগে রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতেন জনসাধারণের কল্যাণে। আর এখন সবাই রাজনীতিতে জড়ান নিজেদের কল্যাণে। অনেকেই রাজনীতিকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছেন।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনেকে নিজেদের হলফনামায় রাজনীতিবিদ উল্লেখ করলেও বাস্তবে তারা পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। কেউ কেউ ব্যবসায়ী পরিচয় না দিলেও নিজের ও পরিবারের নামে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এমপিরা নিজেদের ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রায় সবার আয়ের মূল উৎস হচ্ছে ব্যবসা। ৩৫০ জন এমপির হলফনামা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, হাতে গোনা কয়েকজন এমপি ছাড়া প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। শতকরা হিসাবে শুধু ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২ দশমিক ২৮ শতাংশে। তবে সংরক্ষিত আসন বাদ দিলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশে। আয় বিশ্লেষণ করে পেশা নির্ধারণ করা হলে এ সংখ্যা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন