মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
বড্ড খারাপ সময়ের মধ্যদিয়ে পার হচ্ছি আমরা। বিবেক ও নৈতিকতা আজ বিপন্ন। সবাই অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটছে একটু শান্তির আশায়, কিন্তু শান্তি কোথায়? ঘরে-বাইরে কোথাও এতটুকু জায়গা নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়। মাদকের নেশা সর্বনাশা। এই সর্বনাশা জীবনবিনাশী মাদক আগামী দিনের কর্ণধার তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। গুম, খুন, অপহরণের সাথে বেড়ে চলেছে মাদকের ভয়াবহতা। দেশের আনাচে-কানাচে অবাধে চলছে মাদকের ব্যবহার। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত মহিলাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এখন হাত বাড়ালেই গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, বাংলা মদ, হেরোইন সহজে পাওয়া যায়। মাদকের ভয়াবহতা কত নিষ্ঠুর কত বেদনাদায়ক হতে পারে তা নিজ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ নেশাগ্রস্ত থাকলে সহজে অনুধাবন করা যায়।
জাতিসংঘের এক জরিপ অনুযায়ী ২০০৯ সালে বাংলাদেশে মোট মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৬৫ লাখ যার মধ্যে দেড় লাখ নারী। ঢাকার অলি গলিতে মাদকের রমরমা ব্যবসা চলছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা ইন্সটিটিউট, কাওরান বাজার, আগারগাঁও, তেজগাঁও শিল্প এলাকা এবং আশপাশের বহু জায়গায় উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের ড্রাগ গ্রহণ করতে দেখা যায়। বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ, যার মধ্যে প্রায় ৮০% পুরুষ এবং ২০% নারী। এদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। প্রায় ৬৫% মাদকাসক্ত অবিবাহিত এবং ৫৬% বেকার অথবা শিক্ষার্থী। এরা প্রতিদিন প্রায় ৭০ কোটি টাকার মাদক ক্রয় করে থাকে। সে হিসেবে বছরে প্রায় ২৫,৫০০ কোটি টাকার মাদক ক্রয়ে ব্যয় হয়। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা দেশের উৎপাদনমূলক কার্যক্রমে ভূমিকা রেখে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারতো যদি তাদেরকে আমরা মাদকের সর্বনাশা থেকে রক্ষা করতে পারতাম। যুবসমাজই দেশ ও জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধার এবং সৃজনশীল পথের আলোর দিশারী। অথচ এক শ্রেণীর বিকারগ্রস্ত প্রকৃতির মানুষ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তরুণদের মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যুব সমাজের একাংশ আজ মাদকাসক্তির করাল গ্রাসে নিপতিত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে, যার ফলে বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সুখী সুন্দর পরিবারের স্বপ্ন। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিপথগামী তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে গণসচেতনা সৃষ্টি করার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দেয়া প্রয়োজন।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার রীতিমত মাদকের আগ্রাসন চালাচ্ছে। ভারত থেকে অবাধে আসছে ফেনসিডিল আর মিয়ানমার ইয়াবা নামের ট্যাবলেট পাচার করছে । দেশের সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদকের গডফাদার ও দাগি চোরাকারবারিরা হাজার কোটি টাকার মাদক দেশের ভেতরে নিয়ে আসছে। এর ফলে আমাদের যুবসমাজের একাংশ ক্রমাগতভাবে মাদকের ভয়াবহ ছোবলের শিকার হচ্ছে। মাদকের দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের বিরুদ্ধে সাহস করে টুশব্দ করার কেউ নেই। ভারত শুধুমাত্র বাংলাদেশে পাচারের জন্যই সীমান্তজুড়ে গড়ে তুলেছে শত শত ফেনসিডিল কারখানা। এই যদি হয় বন্ধু রাষ্ট্রের নমুনা তাহলে শত্রুরাষ্ট্রের সংজ্ঞা কি? দুঃখজনক হলেও সত্য, গরু নিয়ে ভারত থেকে আসার সময় বিএসএফের গুলিতে মানুষের প্রাণ চলে যায়। কিন্তু অবাধে ফেনসিডিল আনার সময় কেউ আহত বা নিহত হওয়ার সংবাদ আজো শোনা যায়নি। কিন্তু কেন? সে বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। এ কথা বললে কি অমূলক হবে বিএসএফের সহায়তাই এদেশে পরিকল্পিতভাবে ফেনসিডিল পাচার করা হচ্ছে। আর মিয়ানমার টেকনাফ সীমান্তজুড়ে সাগর তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছে ইয়াবা তৈরির কারখানা। ঐ দেশটিও বাংলাদেশে তাদের সীমান্তরক্ষীদের সহায়তায় ইয়াবা পাচার করছে । এই দুই দেশের দু’ধরনের মাদক আগ্রাসনের কবলে পড়েছে বাংলাদেশ।
দেশজুড়ে মাদকের অভিশপ্ত মরণনেশার আগ্রাসন এখন সর্বব্যাপী। মাদকসেবী সন্তান তার প্রিয় মা-বাবাকে পর্যন্ত খুন করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। একটি দৈনিক পত্রিকার নিজস্ব রিপোর্টে জানানো হয়, গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে কমপক্ষে ২০০ বাবা-মা নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। মাদকসেবী স্বামীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন ২৫০ জনেরও বেশি নারী। নিকট অতীতে রাজধানীর বুকে মাদকাসক্ত কিশোরীর হাতে পুলিশ অফিসার বাবা, সেই সাথে মা খুন হয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ৯০ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৫০ লাখ। এদের মধ্যে ৭০ ভাগ হেরোইন এবং ৩০ ভাগ ফেনসিডিল আসক্ত। ইয়াবা আসক্তের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী নগীরর ঢাকার অলিতে গলিতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে- সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে শুরু হয় মাদকের আড্ডা। ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, হাতির ঝিল, মতিঝিল, বনানী, গুলশান, সদরঘাট, বিভিন্ন রেস্ট হাউসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের আশপাশে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে লোকচক্ষুর সামনেই বিভিন্ন অবৈধ ও অনৈতিক কাজের পাশাপাশি অবলীলায় চলছে মাদকসেবন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর কোন কোন সদস্যের সামনেও তাদের মদদে অবাধে এসকল অসামাজিক কার্যকলাপ চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। সভ্য সমাজে বাস করে আমাদের অসহায়ের মত দেখতে হচ্ছে এ সকল অবৈধ কর্ম।
একটি দেশ বা রাষ্ট্রের বড় সম্পদ হচ্ছে তরুণ সমাজ। তারা বড় হয়ে নিজেদের মেধা ও চরিত্র দিয়ে দেশকে পরিচালিত করবে এটাই তো সবার প্রত্যাশা। সেই তরুণ প্রজন্ম যদি মাদকাসক্তির মতো ঘৃণ্যকর্মে জড়িয়ে পড়ে তখন আর কষ্টের সীমা থাকে না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশকে যদি মাদকমুক্ত করতে হয় তাহলে আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। সন্তানের বয়স সাত বছর হলেই বাবা মায়ের উচিত ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানো। বিশেষ করে নবী- রাসূলের জীবনী পড়ার জন্য জোর তাগিদ দিতে হবে। দেশ সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্থিরতা দূর করতে হলে ৭০ লাখ বিপথগামী তরুণ-তরুণীকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে।
পরিশেষে একটি আবেদন ও প্রস্তাব রাখছি, সরকার থেকে শুরু করে দেশের নাগরিক সমাজ, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, মসজিদের সম্মানিত খতিব, ইমাম, অভিভাবক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতা ও আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী সকলের কাছে আসুন দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সবাই সোচ্চার হয়ে আমাদের কলিজার টুকরা সন্তানদের রক্ষা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন