শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

আসুন, বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই

প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর
দেশের উত্তর এবং মধ্যাঞ্চলের বিশাল এলাকা এখন বন্যা কবলিত। দেশের প্রায় ১৬টি জেলার বিশাল এলাকাজুড়ে বন্যা চলছে। চারিদিকে কেবল পানি আর পানি। এ বন্যার কারণে এতদ অঞ্চলের অসহায়, গরিব মানুষদের জীবনে এখন সীমাহীন দুর্ভোগ। বন্যার পানিতে ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। মাঠের ফসল, ধান ক্ষেত আর তরিতরকারি সবই পানিতে ডুবে ধ্বংস হয়েছে। গোলার ধান, গোয়ালের গরু আর ছাগল সবই ক্ষতিগ্রস্ত। ধ্বংস হয়েছে কয়েক শত পোল্ট্রি খামার। পানিতে ভেসে গেছে হাজারো হাঁস-মুরগি। বন্যার পানিতে হাজার হাজার মাটির ঘর ধসে পড়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির ফসল। মাছের খামার সমুহ ডুবে যাবার কারণে ভেসে গেছে শত কোটি টাকার মাছ। পানিতে ভেসে গেছে হাজারো গবাধি পশু। রাস্তাঘাট, বসত বাড়ি, স্কুলের মাঠ সবই পানির নিচে। মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির-গির্জা সবটার ভিতরেই পানি। বাড়ির বাইরেও পানি, ভেতরেও পানি। দাঁড়ানোর জন্য কোথাও একটু শুকনো জায়গা নেই। বসার এবং ঘুমানোর জন্যও কোথাও একটু জায়গা নেই। সব মিলিয়ে এতদ অঞ্চলের মানুষের জীবনে আজ বড়ই কষ্ট। মহিলা, বৃদ্ধা এবং শিশুদের জীবনে এই কষ্ট আরো বেশি এবং তারা আরো বেশি অসহায়। বন্যার পানিতে ল-ভ- হয়ে গেছে মানুষের জীবন। সবদিকেই কেবল মানবতার হাহাকার। পানির কারণে এ অঞ্চলের কয়েক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও বন্ধ। খাবার পানির বড়ই অভাব। সব নলকূপই পানির নিচে এবং পুকুরসমূহ ময়লা পানিতে ভরাট। রান্না করে খাবার তৈরির সুযোগ কোথাও নেই। শুকনো রুটি, বিস্কুট, মুড়ি আর চিড়া খেয়েই জীবন চালাতে হচ্ছে। এক কথায় ত্রাণের সাহায্যের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে জীবন। এ অবস্থায় সব ভেদাভেদ ভুলে আজ আমাদেরকে দুর্গত মানুষদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এখানে কোন ধরনের রাজনীতি নয়, সংকীর্ণতা এবং বিভেদ নয়। আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে দুর্গতদের রক্ষায় এগিয়ে আসি।
বন্যার কারণে যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। এসব ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়। কিন্তু এখন প্রয়োজন বন্যাদুর্গত মানুষদেরকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করা। তারা যেন আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সে জন্য তাদেরকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। বন্যার সময় সার্বিকভাবেই মানুষের জীবনে কষ্ট নেমে আসে। আবার বন্যার পানি নেমে যাবার পর ও অনেকদিন ধরে বন্যা কবলিত মানুষদেরকে সেই কষ্ট সহ্য করতে হয়। কারণ তখন মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে পানি বাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয় প্রবলভাবে। পুকুরসমূহ ময়লা পানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় ব্যবহারের পানিরও সংকট চলে। মানুষ ব্যাপক হারে ডায়রিয়ার  আক্রান্ত হয়। এ অবস্থায় বন্যার্ত মানুষদেরকে সাহায্য করাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন আমরা বন্যাদুর্গত মানুষদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। সারা দেশের সার্মথ্যবান মানুষেরা যদি আজ এগিয়ে আসে তাহলে এই দুর্যোগকে মোকাবেলা করা কঠিন এবং অসম্ভব নয়। আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে এসব দুর্গত মানুষেরা অচিরেই তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে, একথা আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি। আসুন দুর্গত মানুষদের কাছে পৌঁছে দিই শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ।
বন্যার কারণে যে মানুষটি আজ সর্বহারা তার প্রতি আসুন আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। বন্যার কারণে যে মানুষটির ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, তাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে আসুন মাথা গোজার ঠাঁই করে দিই। যে কৃষকের ফসল ধ্বংস হয়েছে আসুন নতুন করে কৃষিকাজের জন্য সেই কৃষকের পাশে দাঁড়াই। যারা গবাদিপশুকে হারিয়েছে, তাদের হাতে আবারো গবাদি পশু তুলে দিই। ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি এবং মৎস্য চাষিদেরকে আবারো নতুন করে ব্যবসা শুরুর জন্য সহযোগিতা করতে হবে। যে ছাত্রটির বই খাতা নষ্ট হয়েছে সেই ছাত্রটির হাতে আসুন আমরা আবারো বই খাতা কলম তুলে দিই। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা যেন সহজে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ নিয়ে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরায় চালু করতে পারে, সে জন্য ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরকে বর্তমানে বিদ্যমান ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য সময় দিতে হবে। সেন্ট্রাল ব্যাংক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদেরকে সাহাযের জন্য ব্যাংকগুলোকে সহজ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। দেশের এক কোটি মানুষ যদি আজ প্রত্যেকেই মাত্র একশত টাকা করে দুর্গত মানুষদের জন্য দান করে তাহলে নিমিষেই জোগাড় হবে শত কোটি টাকা। আর যদি দান করে প্রত্যেকেই এক হাজার টাকা, তাহলে নিমিষেই জোগাড় হবে হাজার কোটি টাকা। সুতরাং এই উদ্যোগ আজ আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ ধনী মানুষদের আজ দুর্গতদের জন্য অনেক কিছু করার আছে।
যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব তা যদি আমরা দুর্গতদের সাহায্যে দান করি, তাহলে খুব সহজেই বিশাল একটি ত্রাণ তহবিল গড়ে ওঠবে। আর এই তহবিলকে যথাযথ ব্যবহার করে এইসব দুর্গত মানুষকে আবারো সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে। তাই এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আজ সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টরকে ও এগিয়ে আসতে হবে। দেশের মানুষের উপকার করার এখনই সময়। দেশের কর্পোরেট গ্রুপসমূহকে কর্পোরেট স্যোশাল রেসপন্সসিভিলিটির অংশ হিসাবে ত্রাণ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ, বেসরকারি ব্যাংক, দৈনিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ত্রাণ তহবিল গঠন করতে হবে। তারা উদ্যোগ নিলেই তাদের সেই উদ্যোগে এদেশের মানুষেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করবে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেÑ এই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। আজ শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের এবং প্রয়োজন উদ্যোক্তার। মনে রাখতে হবে, এটা জাতীয় সমস্যা। বন্যার কারণে যারা আজ সকল সহায় সম্পদ হারিয়ে বেঁচে আছে তারা সবাই আমার আপনার মতই একজন মানুষ। তারা প্রত্যেকেই আমাদের কারো না কারো পিতা-মাতা, কারো না কারো ভাইবোন অথবা কারো না কারো আত্মীয়। সর্বোপরি তারা মানুষ এবং আমাদের সমাজেরই অংশ। আজ ওরা বিপদগ্রস্ত।
আগামীতে ওদের মতো আমরাও হতে পারি বিপদগ্রস্ত। আজকে ওদের যেমন প্রয়োজন আমাদের সাহায্য, তেমনি আগামীতে আমাদের প্রয়োজন হতে পারে ওদের সাহায্য। সুতরাং মানবতার স্বার্থেই আসুন তাদের পাশে দাঁড়াই।
সামনেই পবিত্র ঈদুল আজহা। সার্মথ্যবান মুসলমানরা ঈদুল আজহার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। এই কোরবানির প্রধান উদ্দেশ্য এবং মর্মবাণী হচ্ছে ‘ত্যাগ’ করা। আর তাই কোরবানির উদ্দেশ্যে জবাইকৃত পশুর মাংসের তিন ভাগের দুই ভাগই ফকির, মিসকিন এবং গরিব আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হয়। সামর্থ্যবান মানুষেরা অনেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে অনেক বড় বড় গরু কোরবানি দিয়ে থাকেন। অনেকে লাখ টাকা পর্যন্ত একটি গরু কেনার পিছনে ব্যয় করে থাকেন। অনেকে আবার একাধিক গরু কোরবানি দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার বিদেশি পশু যেমন উট দিয়েও কোরবানি দিয়ে থাকেন। এবারের কোরবানির জন্য বরাদ্দ টাকার কিছু অংশ যদি আমরা দুর্গতদের পুর্নবাসনে ব্যয় করি এবং বাকি টাকা দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে একটি পশু কিনে কোরবানি দিই তাহলে তাতে কোরবানিও আদায় হবে এবং দুর্গতদেরও কল্যাণ হবে। মনে রাখা দরকার, স্বয়ং স্রষ্টাই মানুষকে মানবতার কল্যাণে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে যে অর্থ আমরা পাব তার একটি অংশও দুর্গতদের পুর্নবাসনে ব্যয় করতে পারি। সুতরাং আজ এসব বিষয় আমাদের ভাবা উচিত।
বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ এবং ১৬ কোটি মানুষের দেশ। এখনো এদেশের শতকরা আশি ভাগ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যেই বেঁচে আছে। স্বাধীনতার বয়স ৪৪ বছর হলে ও আমরা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। এখন ও আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) অন্তর্ভুক্ত। আমরা সবেমাত্র নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছি। আমাদেরকে এখন উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার জন্য কাজ করতে হবে। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে যেসব দেশের অবস্থান ছিল আমাদেরই কাতারে, সময়কে যথাযথ এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে তারা আজ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। দারিদ্র্য, অশিক্ষা আর হতাশাকে জয় করে তারা আজ উন্নত, শিক্ষিত এবং ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে। মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিংগাপুর তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে তারা সর্বদা অগ্রসরমান। এসব দেশের তুলনায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। কলহ আর বিবাদে আমরা সর্বদাই ব্যস্ত। অপ্রয়োজনীয় এবং অহেতুক কাজে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে আমাদের মূল্যবান সময়। তদুপরি বন্যা, খড়া, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস হয়েছে আমাদের নিত্যসংগী। কিছুদিন পরপর এসব আমাদের জীবনে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সুতরাং প্রকৃতির এই প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেই আমাদের বাঁচতে হবে। এদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করার সুযোগ আমাদের নেই। এখানেই জন্মেছি, এবং এখানেই বাঁচতে হবে। প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে আমাদেরকে আবারো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হবে।
সুতরাং আমাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে একতা, বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতি। আসুন, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি, সম্মান করি এবং বিপদগ্রস্ত মানুষদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেকে রক্ষা করি। এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি যেই সমাজে থাকবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সহমর্মিতা। আসুন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মানবতার কল্যাণে কাজ করি। আর একটি কথা, সেথা হচ্ছে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কোন না কোন ধর্মে বিশ^াসী। আর প্রত্যেক ধর্মই মানব কল্যাণকে ধর্মীয় কাজের অংশ করেছে। সুতরাং মানবতার পাশে দাঁড়ানো, বন্যায় বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করাটা ধর্মীয় কাজেরই অংশ। তাই আজ আর কোন ধরনের অজুহাত নয়, কোন ধরনের পিছুটান নয়। সকল ভেদাভেদ ভুলে আসুন সবাই মিলে দুর্গত এসব মানুষদের পাশে দাঁড়াই। অসহায় এসব মানুষের প্রতি সবাই সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার হাত বাড়াই। আমাদের সবার এবং সম্মিলিত সহযোগিতায় সর্বহারা এসব মানুষেরা আবারো তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুকÑ এটাই প্রার্থনা।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
ড়সধৎথপঃম১২৩@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Abhijit Mondal ৬ অক্টোবর, ২০২১, ৮:৫১ এএম says : 0
বন্যার পরিস্থিতির কারণে মানুষের কাছে ত্রান বিতরণ কিছু সাহায্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পশ্চিম বাংলার
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন