গরমের আগেই সাতক্ষীরার উপকুলীয় এলাকাতে খাওয়ার পানি তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। খোলা পুকুরের অনিরাপদ পানি পান করে নানা ধরনের অসুখে পড়ছে উপকুলীয় এলাকার মানুষজন। অন্যদিকে বেসরকারী ভাবে স্থাপন করা পানি বিশুদ্বকরন ফিল্টারগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশই অকেজো হয়ে গেছে। ফলে মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে আসেন সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের নারীরা। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের গাইনবাড়ি গ্রামের গৃহবধু ময়না খাতুন জানান, তার গ্রামের অধিকাংশ মানুষজনই খোলা পুকুরের পানি খেয়ে থাকেন। অথচ একই পুকুরে মানুষজন হাড়ি-পাতিল মাঝাঘোষার পাশাপাশি সাবান সোডা দিয়ে কাপড় পরিস্কার করে। তিনি আরো বলেন, গ্রামে যে‘কটি টিউবঅয়েল রয়েছে তাতে অতিমাত্রার লোনা পানি উঠে। ফলে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না বাধ্য হয়ে সাধারন মানুষজন অস্বস্থ্যকর পরিবেশে খোলা পুকুরের পানি খেয়ে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একই ভাবে খাওয়ার পানি‘র কষ্টের বর্ননা দিলেন মে, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ফুলতলা গ্রা র আরেক গৃহবধু স্বরসতি সরকার। তিনি জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সংসারের জন্য খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন। তিনি পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সকালে বাড়িতে বের হলে দুপুর গড়ে যায় পানি নিয়ে বাড়ি ফিরতে। এতে করে সংসারের কাজে ব্যাহত। শুধু ময়না খাতুন বা স্বরসতি সরকারই নয় শ্যামনগর উপজেলার প্রায় ৪ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ৭০ মানুষের খাওয়ার পানি সমস্যা বা সংকট রয়েছে বলে উপকুলবাসির দাবি। আইলা দুর্গত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, উপকুলীয় অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে তার ইউনিয়নে মানুষজন বিশ্বদ্ধ খাওয়ার পানি কষ্ট পায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রত্যন্তত অঞ্চলের মানুষজন যে পুকুরে কাপড়,কাচা ও গোসল করে সেই একই পুকুরের পানি পান করে থাকে। যে কারনে শিশু ও বৃদ্ধরা নানা ধরেনর অসুখে পড়েন বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই শ্যামনগরে খাবার পানির সংকট শুরু হয়। এর জন্য অপরিকল্পিতভাবে লোনা পানির চিংড়ি চাষ, নদী ভাঙনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যাগকে করছে উপকুলীয়বাসি। শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ৫৭৯৫টি পুকুর ও ১৩৬টি জলমহাল রয়েছে। এছাড়া ৪৬৫টিতে পিএসএফ থাকলেও ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্ধ রয়েছে ৪০ শতাংশ। নদী রক্ষা ও পরিবেশ আন্দোলন নেতা অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী জানান, শ্যামনগরে খাবার পানির সংকট দূরীকরণে পুকুরগুলো সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। এতে যেমন খাবার পানির সংকট কমবে, অন্যদিকে মানুষ দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহার করতে পারবে। উপকুলীয় এলাকায় খাওয়ার পানি নিয়ে কাজ করেন শ্যামনগরস্থ সেসরকারী এনজিও সংস্থা লিডার্স’র নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, উন্মুক্ত জলাশয়ের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমছে। এখন সরকারি-বেসরকারিভাবে খাবার পানির সমস্যা সমাধানে এলাকার মানুষের মধ্যে ট্যাংক, ফিল্টার, ড্রামসহ বিতরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সাথে পিএসএফ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেমের ব্যবহার বেড়েছে। যেসমস্ত এলাকায় টিউবওয়েলে মিষ্টি পানি ওঠে, সেসব জায়গায় পাইপলাইনের মধ্যে খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম জানান, শ্যামনগরের ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টি ইউনিয়নের কিছু কিছু জায়গায় অনেক চেষ্টার পর ডিপ টিউবওয়েল সফল হয়েছে। এটা আশাজনক হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তিনি বলেন, শ্যামনগরের জন্য সবচেয়ে উপযোগী আরও প্লান্ট ও সিটকো প্লান্ট। এর মধ্যে আরও (রিভার্স ওরস্যালাইন) প্লান্ট দ্রæত লবণ পানি সুপেয় পানিতে রূপান্তরে সক্ষম এবং সিটকো প্লান্ট আর্সেনিক ও আয়রন দূরীকরণে বেশ কার্যকরী। এই প্লান্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যয়বহুল হলেও এর মাধ্যমে পানি সংশোধন করে ইউনিয়নে মানুষের খাওয়ার পানি সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। তাছাড়া ইতিপুর্বে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে পিএসএফ স্থাপন করা করা হলেও স্থানীয়রা সেগুলো রক্ষাণাবেক্ষণে উদাসীন হয়ে পড়ে। ফলে সেগুলোও অকেজো যাচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন