মানুষ সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করে প্রকৃত অর্থে সে শান্তির মধ্যেই থাকে। শান্তির উৎস কল্ব বা অন্তর। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: আলা বিজিকরিল্লাহ তাতমাইন্নাল কুলূব- জেনে রাখো, আল্লাহর জিকিরেই কল্ব বা অন্তর প্রশান্ত হয়। (সূরা রা’দ: আয়াত-২৮)
আল্লাহর জিকির ও স্মরণে ঈমানদারের অন্তর প্রশান্ত হয়। জিকির কষ্ট বিহীন একটি ইবাদত। খাঁটি ঈমানদার সব সময় জিকিরে নিমগ্ন থাকে। শত ব্যস্ততা তাঁদের আল্লাহর স্বরণ থেকে বিমুখ করতে পারে না, জিকির ছাড়া খাঁটি ঈমানদার হওয়া কল্পনাতীত। পৃথিবীতে যত নবী রাসুল ও অলি আউলিয়া আগমন করেছেন। সবার সব সময়ের আমল ছিল জিকির। জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। হাদীসে কুদসিতে এসেছে, “আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার ব্যাপারে যেমন ধারণা করে আমাকে তেমনি পাবে। যখন সে আমার জিকির (স্মরণ) করে আমি তার সঙ্গে থাকি। সে যদি তার অন্তরে আমার জিকির স্মরণ করে তাহলে আমিও তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি। আর যদি সে কোনো জনগোষ্ঠীর সামনে আমার জিকির করে, তাহলে আমি তাদের চেয়ে উত্তম জনগোষ্ঠীর কাছে তাকে স্মরণ করি। (মুসলিম শরীফ -২০৬১)। জিকিরের মাধ্যমে শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে এসেছে, যারা পরহেজগার, শয়তান যখন তাদের কুমন্ত্রণাদেয়, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। ততক্ষনাৎ তাদের চোখ খুলে যায়”। (সুরা: আরাফ, আয়াত: ২০১)।
জিকিরকারীর অন্তর চিরজীবন্ত থাকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি তার রবের জিকির করে, আর যে জিকির করে না, তাদের দ্ষ্টৃান্ত হলো জীবিত ও মৃতের মত:” (বোখারী শরীফ -৯৫৮৭)।
জিকির সবচেয়ে সহজ ইবাদত। জিহবার এই ইবাদত সুস্থ, অসুস্থ, দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া সর্বাবস্থায় করা যায়। দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম”- এই বাক্যগুলো জিহবার উচ্চারণে সহজ, আমলের দাঁড়িপাল্লায় ভারী এবং দয়াময় আল্লাহর অধিক প্রিয়।”(বোখারী শরীফ- ৬৪০৬ ও মুসলিম শরীফ -২০৭২)।
আল্লাহর জিকির করার তাকিদ দিয়ে ইরশাদ হচ্ছে: “ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমরা বেশি বেশি করে আল্লাহর জিকির কর”। (সুরা আহযাব: আয়াত-৪১)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন, মানুষের দেহে একটা গোশতের টুকরা আছে, তা যদি ভাল হয়ে যায় তাহলে সারা দেহ ভাল হয়ে যাবে। আর তা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সারা দেহ নষ্ট হয়ে যাবে। আর তা হচ্ছে কল্ব। অন্য হাদীসে আছে: প্রতিটি জিনিস সাফ করার যন্ত্র (রেত) আছে আর কল্বের ময়লা সাফ করার যন্ত্র হচ্ছে আল্লাহর জিকির। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণনা করেছেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: হে আল্লাহর রাসুল! রোজ হাশরে আল্লাহর নিকট কোন বান্দা মর্যাদার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে? তিনি বললেন, যারা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম, আল্লাহর রাস্তায় যারা জিহাদ করে তাদের চেয়েও? তিনি বললেন, সত্য প্রত্যাখানকারী ও মুশরিকদের আঘাত করতে যদি কারও তরবারি ভেঙ্গে যায় এবং রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়, তবুও অধিক পরিমাণে জিকিরকারীগণই তার তুলনায় মর্যাদা দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ হবে। (তিরমিজি শরীফ)।
আল্লাহ আল্লাহ জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য হাসিল হয়। আল্লাহকে সর্ববস্থায় হাজির নাজির জানার মধ্যেই আল্লাহর জিকিরের তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। কিভাবে আল্লাহর জিকির করতে হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নিদের্শনা কোরআনে পাকে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে; তোমার রব এর জিকির করবে মনে মনে বিনয়ের সঙ্গে, সশম্ক চিত্তে অনুচ্চ স্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় এবং তুমি উদাসিন হয়ো না (সুরা আরাফা: আয়াত-২০৫)।
ইলমে তাসাউফে জিকির করার যে পদ্ধতি বিন্যাসিত হয়েছে সেটাই তরিকত এবং তা বিন্যাসিত হয়েছে কোরআন ও হাদীস শরীফে নির্দেশিত পন্থায়। ইলমে তাসাউফের সশব্দ (জলি) জিকির করার নিয়ম যেমন রয়েছে তেমনি নি:শব্দ (খফী) জিকির করার নিয়ম ও রয়েছে। সশব্দ বা জলি জিকির করার নিয়ম হচ্ছে: একবার মুখ ও কলব সহযোগে বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহ নাম উচ্চারণ করা। আর একবার হল কুম ও কলব সহযোগে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা। উভয় বারই আল্লাহ শব্দ দ্বারা কলবে আঘাত করা হয়। এই আঘাতকে আরবীতে সরব বলা হয়। কাদরীয়া তরিকায় এক যরবী ,দুই যরবী, তিন যরবী, চার যরবী, জিকির রয়েছে। এছাড়া ও সশব্দ জিকিরে নফী ইসবাত অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু জিকির রয়েছে। রয়েছে খফী বা নি:শব্দ জিকিরের নানা পদ্ধতি রয়েছে মুরাকাবার নিয়ম নীতি। রয়েছে বিভিন্ন তরিকা। তরিকাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: কাদরিয়া, চিশতিয়া, নকশেবন্দীয়া ও মুজাদ্দেদিয়া তরিকা। এসব তরিকার একাধিক শাখা প্রশাখা রয়েছে। সশব্দ জিকির করার পদ্ধতি এমনভাবে বিন্যাসিত হয়েছে যাতে শত চেষ্টা করেও গলা ছেড়ে দিয়ে তা চিৎকারের পর্যবসিত করা যাবে না। ইলমে তাসাউফ মূলত বিজ্ঞান। শরীয়ত, তরিকত ও হাকিকতের সমন্বয়ে গঠিত এই বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর মনোনিত বান্দায় পরিনত হওয়া যায় এবং ইনসানে কামিল বা পূর্ণ মানব গুনে ভুষিত হওয়া যায়। হযরত ইমাম মালিক (রা:) বলেছেন: যে ফিকহ বাদ দিয়ে তাসাউফ চর্চা করে সে যিন্দীক আর যে তাসাউফ বাদ দিয়ে ফিকহ চর্চা করে সে ফাসিক, আর যে উভয়টাই একত্রে চর্চা করে সে মুহাক্কিক। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন