শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না

প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. এম এ সবুর
আশুরা ইতিহাসের এক বেদনাবিধুর ঘটনা। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের এদিনে ইরাকের কারবালা প্রান্তে ফোরাতের তীরে বিশ্বের ইতিহাসের এক নির্মম হত্যাকা- সংঘটিত হয়। এতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন সপরিবারে শাহাদাৎবরণ করেন। এছাড়া পৃথিবী সৃজন, দুনিয়ায় আদম-হাওয়ার মিলন এবং অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা এ দিনটির সাথে জড়িত। এসব কারণে দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
আশুরা আরবি শব্দ, অর্থ দশ। অর্থাৎ মহররম মাসের দশ তারিখ। হাদিসের ভাষ্য মতে, মহররম মাসের দশ তারিখে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। একই তারিখে বেহেস্ত হতে নির্বাসিত আদম-হাওয়ার পৃথিবীতে মিলন ঘটেছে। নুহ নবী মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছেন একই তারিখে। আবার মুসা নবী ও ইহুদি জাতি ফিরাউনের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন দশই মহররমে। নমরুদের আগুন থেকে ইব্রাহিম নবীর রক্ষা, মাছের পেট হতে ইউনূস নবীর উদ্ধার, ঈসা নবীকে চতুর্থ আসমানে উঠানো সবই ঘটেছে আশুরার দিনে। এছাড়া আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে মহররমের দশ তারিখে। এসব ঘটনার সাথে হিজরি ৬১ সনের একই দিনে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনাও যোগ হয়েছে। অধিকন্তু মহররম মাসের দশ তারিখে মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে। এসব কারণে  সেমিটিক সব ধর্মেই আশুরার গুরুত্ব আছে। কারবালার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগেই ইসলাম আশুরার গুরুত্ব দিয়েছে। এ কারণেই রমজান মাসের রোজার আগে মুসলমানদেরকে এদিনে ফরজ হিসেবে রোজা রাখতে হয়েছেÑ যা ইহুদি ধর্মের বিধানেও আছে। তবে কারবালার মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর মুসলিম সমাজে আশুরা শোকাবহ দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর পর মুয়াবিয়া মুসলিম জাহানের আমির বা শাসক নিযুক্ত হন। আর হযরত আলী তনয় ও মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেন চুক্তি অনুযায়ী মুয়াবিয়ার খেলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। কিন্তু আমিরে মুয়াবিয়ার ইন্তিকালের পর তার পুত্র ইয়াজিদ চুক্তি ভঙ্গ করে অন্যায়ভাবে খেলাফতের দায়িত্ব নেন এবং শাসন ব্যবস্থায় স্বৈরাচার নীতি অবলম্বন করেন। এতে মুসলিম জাহানে বিবাদ-বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়। এহেন পরিস্থিতিতে খেলাফতের ন্যায্য দাবিদার ইমাম হোসেন বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। একদিকে ক্ষমতায় মদমত্ত স্বৈরাচার ইয়াজিদ অন্যদিকে খেলাফতের ন্যায্য দাবিদার মহানবী দৌহিত্র ইমাম হোসেন। ইয়াজিদের সরকারি বিশাল বাহিনী অন্যদিকে ইমাম হোসেনের পক্ষে মুষ্টিমেয় সত্যের সৈনিক।
অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের খেলাফত প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। একদিকে ইয়াজিদের বিপুল সমরাস্ত্র অন্যদিকে ইমাম হোসেন নিরস্ত্র। অধিকন্তু ইয়াজিদের সৈন্যদের দ্বারা ফোরাতের তীরও অবরুদ্ধ। ইমাম হোসেন ও তার সৈনিকেরা তৃষ্ণায় কাতর। এমতাবস্থায় ইমাম হোসেনকে আত্মসমপর্ণের জন্য ইয়াজিদ প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু ইয়াজিদের অন্যায়-অসত্য ও স্বৈরাচারী শক্তির কাছে মাথা নত না করে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। এ অসম যুদ্ধে স্বভাবতই ইমাম হোসেন পরাজিত হন। আর বিজয়ী ইয়াজিদ পাশবিক উম্মাদনায় মেতে উঠেন। তিনি পরাজিত ইমাম হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করেন। সাধারণভাবে যুদ্ধে বিজয়ী প্রশংসিত কিন্তু কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস ভিন্ন। ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় কারবালা যুদ্ধের বিজিত নন্দিত অন্যদিকে বিজয়ী নিন্দিত। নৃশংসতা-নির্মমতার কারণে ইয়াজিদ বর্জনীয়। আর ইমাম হোসেন পরাজিত হয়েও ইতিহাসে স্মরণীয়। অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথা নত না করার জন্য তিনি বিশ্ব বরণীয়। সত্য-ন্যায়ের ঝা-া সমুন্নত রাখার জন্য তার আদর্শ অনুকরণীয়।
প্রতি বছর আশুরা উপলক্ষে ধর্মীয় সভা-আলোচনা দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও তার পরিবার-পরিজনের জন্য দোয়া ও শোক করা হয়। অন্যদিকে কারবালার নির্মম হত্যাকা-ের জন্য ইয়াজিদ ও তার অনুসারীদের নিন্দা-অভিসম্পাত দেয়া হয়। আশুরা উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্যাজিয়া মিছিল বের করা হয়ে থাকে। এতে ‘ওয়া হোসেন! ওয়া হোসেনা! হায় হোসেন! হায় হোসেন!’ বলে বুক চাপড়িয়ে মাতম করে। এমনকি মহানবী পরিবারের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা দেখাতে নিজের শরীর রক্তাক্ত করার দৃষ্টান্তও আছে। এছাড়া কারবালার এ নির্মম হত্যাকা- বিষয়ে মুসলিম সাহিত্যিকদের অনেকেই অনৈতিহাসিক হলেও তেজোদ্দীপক ও রসবোধক মর্সিয়া কাব্য রচনা করেছেন। এসব কাব্য পাঠে মুসলিম মনে মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেন পরিবারের প্রতি ভক্তিভাব-করুণার উদ্রেক করে বটে। তবে এসবে আশুরার মূল উদ্দেশ্য সাধিত না হয়ে বরং ব্যাহত হয়ে থাকে। কারণ আশুরার মূল শিক্ষা অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। নিজের জীবন দিয়ে হলেও সত্য-ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা। যা শুধু মর্সিয়া-মাতমের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। এজন্য প্রয়োজন সত্য-ন্যায়ের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করা এবং অন্যায়-অসত্যের প্রতিরোধে ত্যাগের দীক্ষা গ্রহণ করা।
প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজের এক তাৎপর্য দিন পবিত্র আশুরা। এ দিনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কারবালার বিষাদময় ঘটনা। এতে লুকিয়ে আছে ত্যাগের মহিমা আর সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তাই শুধু মর্সিয়া-মাতম নয় বরং ত্যাগ-কুরবানি আশুরার প্রধান শিক্ষা।
য় লেখক : আহ্বায়ক, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)   

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন