মুহাম্মদ রেজাউর রহমান : ডিসেম্বর মাস এলেই যারা ১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, বাংলাদেশি নারীদেরকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ, কোনো প্রকার বিবেচনাহীন গ্রাম বা শহরের জনপদে বর্বরতার সাথে অগ্নিসংযোগ এসব নীরবে প্রত্যক্ষ করেছেনÑ তারা শ্রেণি নির্বিশেষে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করেছিলেন। কারণ ১৬ ডিসেম্বর প্রায় পঁচানব্বই হাজার আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেদিন বাংলাদেশ- ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। এই দিনেই প্রকৃত অর্থে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দুনিয়ার মাঝে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বাঙালিদের হাজার বছরের ইতিহাসে তাই ১৬ ডিসেম্বরের তাৎপর্য অসামান্য।
নয় মাসব্যাপী অধিকৃত এই দেশে বর্বর হানাদার বাহিনী দেশের প্রতিটি স্থানে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তাতে শহীদ হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। ধর্ষিত হয়েছিল দুই লাখ নারী। দেশের প্রায় এক কোটি অধিবাসী আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। নয় মাস স্থায়ী এক অসম যুদ্ধে সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এক প্রশিক্ষিত ও নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে হানাদার বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছিল। এই প্রত্যক্ষ ও সশস্ত্র যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তানে বাংলাদেশিরা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের ১৭২ জাতীয় সংসদ আসনের ১৭০টিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের আসন সংখ্যা ছিল ১২৮টি। ওখানে জুলফিকার আলী ভূট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। সাধারণ নির্বাচনের পরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িতও করেছিলেন। নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবেÑ এটাও আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণাও দিয়েছিলেন। পয়লা মার্চ মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণী ইন্টারন্যাশনালে শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক। নিকটবর্তী জাতীয় স্টেডিয়ামে হচ্ছিল পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড দলের ক্রিকেট খেলা। হঠাৎ স্টেডিয়ামের দিক থেকে তুমুল হট্টগোল ও গগনভেদী স্লোগান শোনা গেল। কারণ রেডিওর সংবাদে বলা হয় যে, কিছুক্ষণ আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেছেন। দলে দলে দর্শকরা ক্রিকেট খেলা দেখা বাদ দিয়ে সংসদ মুলতবি মানি না, মানি না, বীর বাঙালি অস্ত্রধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর স্লোগানে স্লোগানে আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার মানুষ হোটেল পূর্বাণীর বাইরে সড়কে জমায়েত হয়ে সংসদ অধিবেশন মুলতবি হওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকও স্থগিত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু বাইরে এসে জনতার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ধৈর্য ধরে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বললেন। তিনি ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী ময়দান) জনসভার ঘোষণা দিয়ে সকলকে সভায় যোগ দিতে বললেন।
৩ মার্চ থেকে ঢাকায় নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হবে, প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ইতোমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কয়েকটি আঞ্চলিক ও অপেক্ষাকৃত ছোট দল থেকে নির্বাচিত অনেক সংসদ সদস্যই ঢাকায় এসে পৌঁছেছিলেন। সীমান্তগান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের পুত্র খান আবদুল ওয়ালী খান, জমিয়তে উলামার মাওলানা শাহ আহমদ নূরানী, মুসলিম লীগের মমতাজ দৌলতানা ঢাকায় পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি সমর্থন ও একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। শুধু পিপিপির নির্বাচিত সদস্যরা কেউ আসেননি কারণ পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর হুঙ্কার ছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত সংসদ সদস্যই ঢাকার অধিবেশনে যোগ দিতে গেলে রওয়ানা হওয়ার আগেই তার পা ভেঙে ফেলা হবে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে সকাল থেকেই খ- খ- মিছিল নিয়ে ঢাকা শহর ও পার্শ্ববর্তী চতুর্দিকের জনপদ থেকে আসা শুরু হয়েছিল প্রতিবাদমুখর জনগোষ্ঠীর। ৪৫ বছর আগে ঢাকা এতটা জনবহুল ছিল না। কিন্তু বিকালের মধ্যেই আনুমানিক দশ লাখ লোক জড়ো হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। সভার সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেখা নেই। শোনা গেল, চার ছাত্র নেতা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে জরুরি পরামর্শ সভায় আলোচনারত। ছাত্র নেতৃবৃন্দের প্রচ- চাপ ছিল ৭ মার্চ রমনার জনসভায় বঙ্গবন্ধু যাতে অবশ্যই সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিল শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ বন্ধ না করার। শান্তিকামী বঙ্গবন্ধু তখনও চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হোক। বঙ্গবন্ধু জনসভায় এলেন, মঞ্চে উঠলেন, গগনবিদারী আওয়াজ ও স্লোগানে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ তাকে স্বাগত জানাল। ২৮ মিনিটের এক অপূর্ব জাদুকরী বক্তৃতায় জনতাকে কিছু নির্দেশ, পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন এবং সর্বশেষ ‘এবারের সংগ্রাম-মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে তার তাৎক্ষণিক ভাষণ শেষ করলেন। সভা শুরুর ২/৩ মিনিট পরেই রেডিওর আশরাফুজ্জামান খান জানালেন যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা ভাষণ রেকর্ড করে রাখছেন। ৭ মার্চের জনসভায় কোনো সভাপতি ছিল না, কোনো সঞ্চালক ছিল না। অন্য কোনো বক্তা ছিল না। বঙ্গবন্ধু এলেন, মঞ্চে উঠলেন, ২৮ মিনিট তার তেজোদৃপ্ত জীবনের সেরা বক্তৃতা দিলেন ও মঞ্চ থেকে নেমে ৩২ নং ধানমন্ডি তার বাসার দিকে চলে গেলেন।
৭ মার্চের জের থেকে প্রায় প্রতিদিন দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সভা, শোভাযাত্রা ইত্যাদি। ১৫ মার্চ ঢাকায় এলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভবনে (রমনা পার্কের পূর্ব দিকে) শুরু হয় মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা। এক, দেড় বা দুই ঘণ্টা পর আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলে সংবাদ তৃষ্ণার্ত সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করার আগেই বঙ্গবন্ধু তাদেরকে তার বাসায় যেতে বলতেন।
সাংবাদিকের দল পরি কি মরি হয়ে ছুটতেন ধানমন্ডির ৩২নং সড়কের দিকে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সাথে তার আলোচনার কথা তুলে ধরতেন এবং প্রায় প্রতিদিনই আগামীকাল অর্থাৎ পরবর্তী দিনে পুনরায় কখন প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনায় বসবেন তা জানাতেন। এর মধ্যে আলোচনার তিন-চার দিন পরে জনৈক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন রাখলেনÑ ‘আপনার সাথে শান্তিপূর্ণ পথে সংকটের সমাধানের জন্য আলোচনায় বসলেও পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী প্রতিটি ফ্লাইটে সৈন্য এনে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে কেন?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বললেন, ‘বিষয়টি তার জানা আছে এবং তিনি এটা আলোচনায় উঠিয়েছিলেন।’ ২২ মার্চ পর্যন্ত একটানা প্রতিদিন সাত দিন যাবৎ আলোচনা শেষে পুনরায় কবে আলোচনায় বসা হবে তা না জানালে বঙ্গবন্ধু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের রিপাবলিক দিবস। সারা দেশের কোথাও এমন কি সচিবালয় বা হাইকোর্ট ভবনেও পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখা গেল না। সর্বত্র উড়ছিল, ছাত্রনেতাদের দ্বারা প্রস্তাবিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
সেদিন বিকাল থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে পাঁচজনের এক প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের এক প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনায় বসেন। ২৪ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বা তার প্রতিনিধি দলের সাথে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের বৈঠক আসলে ছিল প্রতারণা। আলোচনার অজুহাতে সময় নষ্ট করাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনী ও আমলাদের একটি চাল। ২৫ মার্চ সকাল থেকেই তার বাসায় যেসব আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী তার সাথে দেখা করেছেন তাদের প্রত্যেককেই তিনি নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলেছেন। তার পরামর্শে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত প্রায় প্রত্যেক সংসদ সদস্যই আত্মগোপনে চলে যান।
২৫ মার্চ দিনগত রাত ১২টায় শুরু হয় এক নিরস্ত্র জনগণের ওপর আধুনিক সকল প্রকার মারণাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর আক্রমণ ও গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতের পর থেকে পরবর্তী নয় মাস হানাদার পাকিস্তানিরা ৩০ লাখ বাংলাদেশিকে হত্যা করে, দুই লাখের মতো নারীকে ধর্ষণ করে, জনপদের পর জনপদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে ভারত আক্রমণ করে। ১৩ দিনের যুদ্ধে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুই ফ্রন্টেই তারা পরাজিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর প্রায় পঁচানব্বই হাজার হানাদারের পক্ষে জেনারেল নিয়াজী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার পরে চট্টগ্রাম নৌবাহিনী সদর দফতরে যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানি কমোডরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলÑ পঁচানব্বই হাজার সৈন্য, অত্যাধুনিক সকল প্রকার যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়েও তাদের এ রকম পরিণতি কেন? পাকিস্তানী কমোডর বলেছিলেন, তুমি একটা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছো, গ্লাসটা পানিতে ভরে গেলে পানি উপচে পড়বে। আমাদের পাপের ঘড়াও তেমনি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন