সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

কুড়িগ্রামে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটা করছে সর্বনাশ

| প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে : কুড়িগ্রামে অবৈধ ইটভাটার ছড়াছড়ি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, ব্যক্তি মালিকানাধীন মূল্যবান গাছের বাগান এবং আবাদি জমিতে যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব অবৈধ ভাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কুড়িগ্রাম জেলা। নাগেশ^ররী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের ভাঙ্গামোড় এলাকায় আনিছুর রহমান সরকার অনুমোদন ছাড়াই চালাচ্ছেন ‘এএমডি ব্রিকস’ নামে একটি ভাটা। নেই জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স এবং বাধ্যতামূলক পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। ভাটা স্থাপনে মানা হয়নি সরকারি কোন বিধি-বিধান। তিন ফসলি জমিতে স্থাপিত এভাটার চারদিকে ঘন বসতবাড়ি, হাজার হাজার গাছপালা। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার ব্যবসা চলছে প্রায় কোটি টাকার উৎকোচ বাণিজ্যের জোড়ে। জেলা প্রশাসকের দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় কাগজ-কলমে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদিত এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স প্রাপ্ত হাওয়াভাটা মাত্র ২৬টি। নতুন আবেদনকৃত ১৭টি ইটভাটা লাইসেন্স না পেলেও ইট পোড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের একটিরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। অনেক ভাটায় এখনও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে বেসরকারি হিসেবে জেলায় ভাটার সংখ্যা ৬০টি। যার অধিকাংশই অবৈধ। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, লাইসেন্স নেই এবং আবেদনও করেননি লুৎফর রহমান রনির ডিকে ব্রিকস, রাজারহাট ও সাহিদুর রহমান এস এ ব্রিকস। এরকম কমপক্ষে আরো ১০টি ইটভাটা সরকারি আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চালু রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। ফলে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। এ সুযোগে পকেট ভারি করছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নাগেশ^ররী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের ভাঙ্গামোড় এলাকার ‘এএমডি ব্রিকস’ সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সরকারের কোনো আইন-কানুনই মানা হয়নি এখানে। নেই লাইসেন্স, নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। এমনকি নেয়া হয়নি জেলা প্রশাসনের অনুমোদন। পোড়ানো হচ্ছে ইট। বঞ্চিত হচ্ছে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব আয় থেকে। একটি প্রভাবশালী চক্রের ছত্র ছায়ায় আনিছুর রহমান গং অবৈধ এ ভাটাটি দীর্ঘদিন থেকে চালাচ্ছে। আশপাশের এলাকার গাছ মরে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে আবাদি জমি এবং জমির ফসল। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ অবৈধ কার্যক্রম চললেও দেখার কেউ নেই। বারবার অভিযোগ করেও প্রতিকার পায়নি এলাকাবাসী। ভাটা সংলগ্ন আইয়ুব আলী জানান, ভাটার ধোঁয়ার কারণে তার এক একর জমির ধানের উৎপাদন ভালো হয়নি, ধানের শীষ জ্বলে যায়। বাড়িতে হয় না কোনো ফলফলাদি। সুপারি ধরলেও চিটা হয়ে ঝরে পড়ে। এক একর জমিতে যেখানে আগে ৬০/৬৫ মণ ধান হতো এখন সেখানে হয় মাত্র ২০/২৫ মণ। আবুল হোসেন ও মোহাম্মদ আলী জানান, শ্বাস কষ্ট, হাঁপানিসহ নানা রোগ দেখা দিয়েছে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউ নিস্তার পাচ্ছে না এর হাত থেকে। আবু বক্কর সিদ্দিক একই সুরে বলেন, তিন ফসলি এ জমিগুলোতে এখন আর আগের মতো অবাদ হয় না। ফলে খাদ্য সংকটে পড়েছেন তারা। এ ব্যাপারে তারা জেলা প্রশাসক, উপ-পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর, মহাপরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর এবং সচিব বনও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বরাবর অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি। এলাকাবাসী নুরনবী, মফিজল ও আব্দুল করিম জানান, বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে এলাকার বেশিরভাগ ফলজ ও বনজ গাছ মরে যাচ্ছে। যেগুলো বেঁচে আছে তা খর্বকার, চিকন এবং পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। জমিতে ফসল হচ্ছে না ভালো, ধানে চিটা হচ্ছে বেশি, বোরো চাষে পানি ও সার লাগছে বেশি। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, বড়ই, নারকেল, সুপারিসহ কোন ফলফলাদি এবং রবিশস্য ঠিকমতো হচ্ছে না। শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ চর্মরোগ, শ্বাস কষ্ট, হাঁপানি, যক্ষাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৬টি ইটভাটার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। আর ১৭টি ইটভাটার আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও পরিবেশ ছাড়পত্র থাকলে সরেজমিন তদন্ত করে লাইসেন্স দেয়া হবে। লাইসেন্স পাওয়ার আগে ইটভাটা চালু পুরোপুরী আইনের লঙ্ঘন। লাইসেন্স বিহীন ইটভাটার ব্যাপারে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, লাইসেন্স সংক্রান্ত কাজে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কোনো প্রকার আর্থিক অনিয়মের সুযোগ নেই। অভিযুক্ত এ এম ডি ব্রিকসের মালিক আনিছুর রহমান, মাসুদ রানা মাসুদ ও দুলাল। তারা জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেতে আড়াই লাখ টাকা এবং জেলা প্রশাসকের দপ্তরে লাইসেন্স পেতে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ইটভাটা চালু করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স পাবেন বলে তারা আশাবাদী। বাস্তবতা হলো- আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে লাইসেন্স ও পরিবেশ চাড়পত্র পেতে বিলম্ব হয়। আর এজন্য বসে থাকলে ব্যবসার বারোটা বাজবে। একাধিক ইটভাটা মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সকল ইটভাটা মালিককে জেলা প্রশাসকের ‘এলার ফান্ডে’ এক লাখ করে টাকা দিতে হয়েছে। এছাড়া ভাটা চালাতে গেলে নানা পক্ষকে সেলামি দিতে হয়। অধিকাংশ ইটভাটার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই স্বীকার করে আরো বলেন, ভাটাগুলো এভাবেই চলছে দীর্ঘদিন থেকে। তারা উল্টো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের আইন-কানুন ও শর্ত মানলে জেলার সকল ভাটাই অবৈধ। কারণ নিয়ম অনুযায়ী তিন কিঃমিঃ এলাকায় বসতবাড়ি, গাছপালা থাকলে এবং আবাদি জমিতে ভাটা করা যাবে না। কৃষি জমির মাটি ব্যবহার করা যাবে না। লাইসেন্স ব্যতীত ইট প্রস্তুত নিষিদ্ধ। ভাটা স্থাপনের জন্য ফাঁকা এলাকা এবং পতিত জমি কোথাও কী পাওয়া যাবে? কাজেই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন সবেই জানে। আর তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় এসব ইটভাটা চলছে। আর নানা আইনি জটিলতা এবং ঘাটে ঘাটে উৎকোচ বাণিজ্যের কারণে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই অনেকে ব্যবসা করছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন