শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

রাজধানীর জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগ

| প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. এনামুল হক খান : কয়েক ঘণ্টা ভারী বর্ষণে ঢাকা শহর ডুবে যায়। পানি আটকে থাকায় মানুষের চলাচলকে ব্যাহত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই শহর আমাদের রাজধানী, দেশের প্রাণ। এর অন্যতম দিক হচ্ছে চারিদিকে নদী। নদীগুলোতে কোন জোয়ার ভাটা নেই। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু এই নদীগুলো থাকার পরও এখানে জলাবদ্ধতা হয়, এটা আমাদের চরম ব্যর্থতা। পৃথিবীর অনেক দেশে পানি নিষ্কাশনের জন্য নদীর সাথে সংযোগ নেই, কিন্তু আমাদের আছে। নদীর পাশে শহর; নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থাসহ একে স্বাস্থ্যকর, নান্দনিক করে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু আমরা তা পারিনি। না পারার কারণেই এই শহর বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে। এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। তাছাড়া ব্যর্থতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে নগরীর খাল এবং ডোবাগুলোর করুণ পরিণতি। আমরা নিজ হাতে এগুলোকে হত্যা করেছি। খাল ভরাট করে লেক তৈরি করেছি, রাস্তা বানিয়েছি, বক্স কালভার্ট করেছি, আবার খালের দুই পাশ দখল করে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করেছি। পুকুর-ডোবা আমাদের হাতেই নিঃশেষ হয়েছে। নগরীতে পুকুর-ডোবা রাখতে হবে, পুকুর পাড়ে গাছ থাকবে, চার পাশে ফুটপাথ ও বাগান থাকবে, এলাকা ভিত্তিক পার্ক থাকবে, খেলার মাঠ থাকবে, সবুজ গাছপালা থাকবে, তবেই হবে সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত শহর। পুকুর-ডোবা রক্ষা করতে বিশেষজ্ঞরা বললেও কোন কাজ হয়নি। প্রতিরোধ-উচ্ছেদ করার মতো সাহসী ভূমিকা কেউ নেয়নি। রাজধানীর কিছু রাস্তা ও ফুটপাথের নিচে মাস্টার ড্রেন হিসেবে বসানো হয়েছে ছোট বড় পাইপ লাইন। যা ফুটপাথের উপরে টাইলস্ দ্বারা আবৃত। রাস্তার নিচেও পাইপ লাইন আছে। যেখানে রাস্তা সরু সেখানে পাইপ লাইন রাস্তার মাঝে। এই পাইপ বসানো ড্রেনগুলো যাতে প্রতি বছর পরিষ্কার করা যায় সেই ব্যবস্থা নেই। যারা পরিষ্কার করে, তারা শুধু ঢাকনার নিচের কিছু অংশে পরিষ্কার করে, বাকী অংশের ময়লা-আবর্জনা থেকে যায়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ইট, পাথর, বালি, ডাবের খোসা ইত্যাদি জমা হতে হতে একসময় পাইপ ভর্তি হয়ে যায়। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, বৃষ্টি হলে পানি আটকে যায়, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাটবাজার, অফিসপাড়া-আবাসিক এলাকা সবই তলিয়ে যায়। এর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করে, ফলে অল্প সময়ে রাস্তা ভেঙ্গে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। আবার অসচেতন নগরবাসী যত্রতত্র ময়লা ফেলার কারণে নগর বর্জ্যে সয়লাব হয়, বাতাস হয়ে উঠে বিষাক্ত। একসময় সেগুনবাগিচা খাল, ধানমন্ডি খাল, গুলশান-বনানী খাল, কল্যাণপুর খাল যাকে বলা হতো কালাই নদী, শান্তিনগর খাল, ধোলাই খালসহ অন্যান্য খাল দিয়ে পাল তোলা নৌকা চলত। নগরীর ব্যবহৃত পানি, বৃষ্টির পানি খাল দিয়ে চলে যেত। এগুলো আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারিনি। খালগুলো উদ্ধার করা জরুরি। আরো জরুরি আবাসিক এলকার কিছু অংশ ঢালাই বিহীন রাখা, যাতে পনি সহজে মাটির নীচে যেতে পারে। আর ফুটপাথের নিচে পাইপ লাইন বসানোর কাজ বন্ধ করতে হবে। কারণ ময়লায় পাইপ ভর্তি হলে ভাঙতে হয় পাইপ লাইন, উপরের ঢালাইসহ বসানো টাইলস্ ভেঙ্গে ফেলতে হয়। লক্ষ-কোটি টাকা খরচ করে আবার নতুন পাইপ লাইন বসাতে হয়। এর পরিবর্তে তৈরি করতে হবে ক্যানেল টাইপ মাস্টার ড্রেন। থাকবে রাস্তার পানি ড্রেনে ঢুকতে রডের জালি, থাকবে পাটাতনের মতো ঢাকনা। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ঢাকনার উপর টাইলস্ বসানো যেতে পারে। এতে প্রতি এক-দুই বছর পর পর টাইলস্ ভেঙ্গে পাটাতন সরিয়ে ক্যানেলের ভারী বর্জ্য সরিয়ে দিলেই চলবে। এতে ড্রেন নাব্য হয়ে উঠবে। এতে খরচ কম হবে, ময়লা পরিষ্কার করা সহজ হবে, পরিকল্পনা মোতাবেক কাজটি হাতে নিতে হবে যাতে বর্ষায় এমনটি না হয়। আমরা দীর্ঘদিন লক্ষ করছি, পাইপ লাইনের ড্রেন থেকে ময়লা সরানো সহজ হয় না, জমা থাকে বছরের পর বছর। আবার যে খালগুলোতে বক্স কালভার্ট করা হয়েছে, মানুষ আশা করেছিল হয়ত মেশিনের মাধ্যমে ময়লা সরিয়ে দেয়া হবে বা কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে এই ময়লা আবর্জনা অপসারণ করা হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। তাই একটু বেশি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসী হয়ে পড়ে অসহায়। তাদের চলা ফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু বাধাগ্রস্থ হয়। ডাস্টবিন-স্যুয়ারেজ লাইন-ড্রেনের ময়লা-আবর্জনায় নগর একাকার হয়ে পড়ে। নগরী মশা, মাছি, পোকামাকড়-কেঁচো ইত্যাদির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। মানুষ চর্মরোগ, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া, জ¦র, কলেরা, আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়। নগরীতে নির্মল বায়ুর অভাব হয়। শুধু তাই নয়, জলাবদ্ধতার কারণে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভারগুলোও অনেক স্থানে তলিয়ে যায়, তাতে বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তির সমস্যা দেখা দেয়। সেই সাথে সেপটিক ট্যাঙ্কগুলোও তলিয়ে যায় পানির নিচে। এখানে প্রতিনিয়ত লোকসংখ্যা বাড়ছে। এর আয়তন বর্তমানে প্রায় ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার আর লোকসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখের উপরে। নগরের আয়তন বাড়ছে, গড়ে উঠছে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা। জায়গা নেই বলে অলি-গলির রাস্তার প্রসস্থ করার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাস বলছে, মুঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ৫০ হাজার সৈন্য ও ৫০ হাজার পাইক-পেয়াদা নিয়ে ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা এবং ধলেশ^রী নদী প্রবাহের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বুড়িগঙ্গার তীরে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। সেই থেকে রাজধানী ঢাকার যাত্রা।
সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই নগর অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে, যাত্রাবাড়ি, দনিয়া, ডিএন্ডডি, ফকিরাপুল, মোহাম্মদপুর, পুরাতন ঢাকা, কাওরান বাজার, উত্তরার কিছু অংশ, নটরডেম কলেজের সামনের অংশ, মতিঝিল সার্কুলার রোড, শাপলা চত্ত¡রের পশ্চিম অংশ, শেওড়াপাড়া, আসাদগেট, মিরপুরের নিচু এলাকাগুলোর দুর্দশা অবর্ণনীয়। জলাবদ্ধতার দিকে নজর না দিলে এই নগরকে বেশিদিন সচল রাখা সম্ভব হবে না। নগরে খরা মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। পানির স্তর নিচে নামার কারণে চাপকলগুলো অকেজো হয়েছে। অনেক গভীরে গেলে পানি পাওয়া যায়। আবার, ঢাকার চারপাশের নদীর পানিতে স্যুয়ারেজ বর্জ্য ও কলকারখানার বর্জ্যরে মিশ্রণের কারণে এত দূষিত যে, সেখানে মাছসহ জলজ প্রাণি মরে যাচ্ছে, বেঁচে থাকতে পারছে না, পানির রং কালো হয়ে গেছে। আব্দুল গনি ওয়াটার ওয়ার্কসের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার পানি এবং সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এর মাধ্যমে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করা হয়। এর সাথে আছে গভীর নলকূপের পানি। নগরবাসী জানে ঢাকা ওয়াসা নির্মাণ করেছিল ওভারহেড ওয়াটার ট্যাংক, যেগুলো আজ অকেজো। এটা অর্থের অপচয়। আর অপচয় বাড়ানো ঠিক হবে না। তাই কয়েক বছর পর পর বর্জ্য নিষ্কাশনে ভূ-গর্ভস্থ পাইপ লাইন ভাঙ্গা ও গড়া বন্ধ করতে হবে। আর নগরবাসীর ব্যবহার ও পান করার জন্য যে পানি সরবরাহ করা হয়, এই পানি দিয়ে মানুষ থালাবাসন, কাপড় ধোয়, গোসল করে। পানি বিশুদ্ধ কিনা মানুষের সন্দেহের কারণে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই আছে ফিল্টার, তারা পরিশোধনের পর এই পানি পান করে। আবার কোন কোন পরিবার এই পানি সিদ্ধ করে পান করতে যেয়ে প্রতিদিন প্রচুর গ্যাস- বিদ্যুৎ খরচ করে- এতে বহু শ্রম ঘণ্টাও নষ্ট হয়। যা দেশ ও জনগণের আর্থিক অপচয়। যদি আমরা প্রিয় রাজধানীকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারি- একসময় তাকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে জাতি তাদের নগর, বন্দর, সভ্যতা রক্ষায়, যত বেশি যতœশীল ও সতর্ক ছিল তাদের ঐতিহ্য তত বেশি সময় টিকে ছিল। যারা সতর্ক ছিল না সেই তাদের নগর অল্প সময়ে পরিত্যাক্ত হয়েছে, নষ্ট হয়েছে।
আমরা জানি- ব্যাবলনীয় সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাচীন পুন্ড্র নগর বর্তমানে বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরে শীতাকোট বিহার, কান্তজীর মন্দির, নওগা জেলার সমৃদ্ধ নগরী পাহাড়পুর যার আদি নাম সোমপুর, সমৃদ্ধ নগরী কুমিল্লার ময়নামতি, বিক্রমাদিত্বের রাজধানী বিক্রমপুর এবং বাংলার আদি রাজধানী সোনারগাঁ বিভিন্ন কারণে বিলুপ্ত হয়েছে, পরিত্যাক্ত হয়েছে। আমরা আমাদের রাজধানী ঢাকাকে পরিত্যাক্ত হতে দিতে চাই না। আমরা সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাস করতে চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য নগরী হিসেবে রেখে যেতে চাই।
আজ আমাদের রাজধানীতে রাস্তার ধারণ ক্ষমতার চাইতে যানবাহন বেশি। ট্রাফিক এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খায়। সেই সাথে রয়েছে রিক্সার অবাধ চলাচল। রিক্সাকে অল্প কিছু সড়কের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে হবে। ফুটপাথ থাকবে শুধু পথচারীদের জন্য। ফুটপাথের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করা জরুরি। লক্ষ করা যাচ্ছে, জলাবদ্ধতা হলে নগরীর টেলিযোগাযোগ লাইন, বিদ্যুৎ লাইনে সমস্যা দেয়া দেয়। অনেক স্থানে গ্যাস লাইনগুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শহরে রিক্সা-গাড়ির জট লেগে যায়। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল-কলেজ এবং অফিস ছুটির সময় মানুষের দুর্ভোগ হয় চরমে। এবার লক্ষ করা গেছে, আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার পানির নীচে চলে যাওয়ায় পানির পাইপগুলোতে ময়লা পানি ঢুকেছে। তাই জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পেতে আমাদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। আর নগরীর ময়লা আবর্জনা আপসারণে নিতে হবে বিশেষ নজরদারী। নি¤েœ কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হল। স্বল্পব্যায়ী ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও জনদুর্ভোগ আশা করি কমবে।
১. রস্তায় যাতে পনি না আটকায় সে জন্যে পাইপ লাইন না বসিয়ে ফুটপাথে যথাযথ ¯েøাপ সহকারে পাকা ক্যানেল তৈরি করে- মাস্টার ড্রেন গড়তে হবে যাতে থাকবে পাটাতনের ন্যায় ঢাকনা। পাটাতন সরিয়ে যাতে কয়েক মাস পর পর হালকা ও ভারী ময়লা পরিষ্কার করা যায়। রাস্তার সংযোগ স্থানে থাকবে জালি। ২. ঢাকার বিভিন্ন খালে নির্মিত বক্স কালভার্টগুলো ভেঙ্গে দুই পাশে রাস্তা এবং মাঝে ঢাকনা দেয়া ক্যানেল টাইপ পাকা ড্রেন নির্মাণ করাই যুক্তিযুক্ত। ৩. যেখানে ফুটপাথ নেই, রাস্তা সরু সেখানে পাইপ লাইন রাখা যেতে পারে। ৪. পলিথিন, ময়লা-আবর্জনা যাতে যত্রতত্র না ফেলা হয়, নগরবাসীকে সচেতন করতে প্রচার মাধ্যমগুলো কাজে লাগাতে হবে। ৫. প্রতিদিন ভোরে ডাস্টবিনের ময়লা ডাম্পিং স্টেশনে নেয়া নিশ্চিত করতে হবে। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা যাতে অসুস্থ হয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। ৬. হাসপাতালের বর্জ্য ডাস্টবিনে না ফেলে সরাসরি ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যেতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও সংগঠক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন