চিকিৎসা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। উন্নত রাষ্ট্রে এ অধিকার নাগরিককে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে তা নামমাত্র মূল্যে প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় বাংলাদেশে। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা এখন পরিপূর্ণ বাণিজ্যিকখাতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নীতি-আদর্শ, শৃংখলাবোধ, সেবার মানসিকতা ও মানবিকমূল্যবোধ একেবারে লোপ পেয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্টদের মাইন্ডসেটও পাল্টে গেছে। যার জ¦লন্ত প্রমাণ তিনটি হাসপাতাল ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রসূতি পারভীনের রাস্তায় সন্তান প্রসব। চিকিৎসাখাতের জন্য এ এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এর মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার আসল চিত্রটি ফুটে উঠেছে। গুটি কয়েক ব্যক্তির জন্য পুরোখাতকে বদনামের গøানী বহন করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে। একতো অসুস্থতার জন্য তাদের শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে, আবার টাকার অভাবে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। রোগী ও বিপদগ্রস্তদের জিম্মি করে টাকা আদায় করা এখন নিত্য ও সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
আমাদের পাশর্^বর্তী রাষ্ট্র ভারতের চিকিৎসা ও সেবার সাথে যদি আমাদের দেশের চিকিৎসা ও সেবার মান তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যায় আমরা কত পিছিয়ে। সেখানে চিকিৎসা উন্নত, সেবার মান ভালো, তুলনামূলক খরচও কম। পাশের দেশের সাথে চিকিৎসা খাতে কেন আমাদের এত দূরত্ব, ব্যবধান ও পার্থক্য? তাদের প্রশিক্ষণ ও আদর্শ কেন আমরা গ্রহণ করি না? কেনো তাদের প্রযুক্তি, গবেষণা ও সেবাগুলো আমরা গ্রহণ করি না? মন্ত্রী-এমপি, সচিব-আমলা, রাজনৈতিক নেতা, উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালশিয়া ও ভারতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এজন্য তাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাখাত নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। সমাজের মধ্যবিত্তরা প্রাইভেট ক্লিনিকে আর গরীব ও নি¤œবিত্তরা সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে। এ যদি হয় দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান ও অবস্থা, তাহলে গরীব, দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী অসহায় ও হতদরিদ্র লোকগুলো যাবে কোথায়?
চিকিৎসা খাত হচ্ছে পরিপূর্ণ সেবামূলকখাত, সম্মানজনক ও পবিত্র পেশা। যাদের সেবার মানসিকতা আছে তাদেরই এসব খাতে জড়িত হওয়া উচিত। সেবার মানসিকতা ও মানবিকমূল্যবোধ যারা লালন করেন, সেসব উদার, আদর্শবান ও মহৎ ব্যক্তিদের চিকিৎসাখাতে এগিয়ে আসা উচিত। বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে যারা এ সেক্টরের সাথে যুক্ত হয় তাদের কাছ থেকে সেবা ও মানবিকতা আশা করা অরণ্যে রোদন। সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি শারীরিক ফিটনেস দেখা হয়। অনুরূপভাবে মেডিকেল সায়েন্সেও ভর্তি প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি মাইন্ডসেটও পরীক্ষা করা উচিত। যাদের নাগরিকের সেবা করার মত মহৎ ও উদার মানসিকতা আছে, যারা নীতি-আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ লালন করে তাদের ভর্তিতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। শুধুমাত্র টাকা উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বাণিজ্যিক সেক্টরের অভাব নেই। চিকিৎসা খাতকে একমাত্র উপার্জন খাত মনে করা ভুল। যারা বাণিজ্যিক উদ্যেশ্য নিয়ে এ সেক্টরের সাথে জড়িত, তাদের দ্বারা এ খাতের উন্নয়ন, উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ-দোহাই আপনারা সেবামূলক খাতকে বাণিজ্যিক খাতে রূপান্তরিত করবেন না। চিকিৎসকের মত পবিত্র, সম্মানজনক ও মহৎ পেশাকে কলঙ্কিত, অপমানিত ও বিতর্কিত করবেন না।
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন