পবিত্র কুরআনে ‘মহানবী (সা.)-কে উসওয়াতুন হাসানা বা মানব চরিত্রের সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলামের শেষ নবী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন উন্নত এক মহান চরিত্রের অধিকারী। অতএব কোনো কারুকার্যময় বিশেষণ অথবা কৃত্তিমতার আবরণে চিত্তাকর্ষক কোনো মন্তব্যের দ্বারা তাঁকে চিহ্নিত করার আদৌ প্রয়োজন নেই। মহানবীর দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি এবং কাজকর্ম ছিল এত বাস্তুবধর্মী যে, কোনো মন্তব্য ছাড়াই সে সবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা চলে এবং মহানবীর জীবন থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। সমুদ্রের তীরে বসে যদি কেউ বিশাল সমুদ্রের দিগন্তবিস্তৃত নীল জলরাশি দেখতে থাকে, অথবা হিমালয়ের চূড়ায় উঠে কেউ যদি চারদিকে কিংবা নিঃসীম নভোনীলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তখন যেমন সে ভীত বিহŸল হয়ে তার অভিজ্ঞতা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে না, ঠিক তেমনি মহানবীর জীবনেও এক মহাসমুদ্র।
খ্যাতনামা পারস্য কবি ও দার্শনিক শেখ সাদী (র.) আরবিতে রচিত কবিতার মাত্র চারটি লাইনে মহানবীর সাফল্য তুলে ধরেছেন। কবি সাদী মহানবীকে দেখেছেন অন্তর দিয়ে এবং পরিপূর্ণ ভক্তি সম্মান ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে; যে ভালোবাসা এবং প্রেমের বাণী তিনি ছড়িয়ে গেছেন সমগ্র বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর জন্য। যে চারটি পংক্তির মধ্য দিয়ে শেখ সাদী বিশ্বনবীর জীবন চিত্রায়ন করেছেন তা হচ্ছে এই :
‘কাজের মধ্য দিয়ে মানব জাতির মধ্যে তিনি হয়েছেন শ্রেষ্ঠ। তাঁর অনুপম সৌন্দর্যচ্ছটা বিদীর্ণ করেছে অন্ধকারকে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর ব্যবহার ছিল মাধুর্যমÐিত। মহানবী ও তাঁর বংশধরদের ওপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক।”
এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন জীবনে যারা এক বা একাধিক ক্ষেত্রে বড় হয়েছেন। যেমন নেপোলিয়ান যুদ্ধক্ষেত্রে তার অপূর্ব যুদ্ধকৌশলের জন্য সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রেরণা ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হতেন। পক্ষান্তরে আমেরিকান কবি এবং ঐতিহাসিক এনজার সোল ইতিহাসখ্যাত মহাবীর নেপোলিয়ানের হত্যা, অত্যাচার এবং নিপীড়নের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করার পরিবর্তে নিজেকে এমন একজন কৃষক হিসেবে কল্পনা করতে ভালোবাসতেন, যে স্ত্রীর সান্নিধ্যে থেকে তার দস্তানা বুনে দিতে ভালোবাসবে এবং শরতের রৌদ্রকিরণের পরশে পেকে ওঠা আঙ্গুরের ক্ষেত দেখার মাধ্যমেই লাভ করবে সুবিমল আনন্দ। সক্রেটিস দর্শনের দিক থেকে এবং বিশ্লেষণমূলক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে অন্যান্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অথচ এমনি এক অসাধারণ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও সারারাত সূরা পানে থাকতেন বিভোর এবং তার স্ত্রী ‘জেনথিপি’ প্রায়ই নির্দয়ভাবে তার মাথায় গরম পানি ফেলে দিতেন। গ্রিসের হোমার, পারস্যের ফেরদৌসী, ইংল্যান্ডের শেক্সপিয়র এবং প্রাচীন ভারতের কালিদাস এরা সকলেই কাব্য ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু কবি কালিদাসের মৃত্যু ঘটে দক্ষিণে ভারতের এক পতিতাগৃহে। মানুষের জীবনে এক বা একাধিক ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করা খুব কঠিন কিছু নয়, কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমভাবে মহত্বের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করা দর্লুভ ঘটনা এবং এ বিষয়ে মরুদুলাল মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এমন ক্বতিত্ব প্রর্দশন করেন যা ছিল একেবারেই তুলনাবিহীন।
দূরে থেকে কোনো জিনিস দেখতে সর্বদাই উজ্জ্বল মনে হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সমুদ্রের ভয়াল ঢেউগুলো দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন সমুদ্রে বিছানো রূপোর পাতাগুলো চমকাচ্ছে। কিন্তু মানুষের মূল্য কখনো দূরে থেকে ক্ষণিকের দেখা লোকদের স্তুতি বা প্রশংসা দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। মানুষ এবং তার বিষয়ে বিচারে জনগণ অনেক সময়ই হয়তো গুরুতর রকমের ভুল করে বসে এবং সত্যি বলতে কি, আমাদের অধিকাংশ সামাজিক দুর্গতির মূলেই রয়েছে এসব কারণ।
এ কথা সত্য যে, কোনো ব্যক্তির প্রকৃত মূল্য নির্ণয় করা শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ঘনিষ্ঠভাবে তার সাথে মেশার সুযোগ পায়। সেই ব্যক্তিই মহান, যিনি তার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভৃত্য এবং প্রতিদিনের সঙ্গী-সাথীদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র।
হজরত খাদিজা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যৌবনের বছরগুলোতে একমাত্র জীবন সঙ্গিনী আর আল্লাহর রাসূল হিসেবে তিনিই প্রথম তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং আল্লাহর প্রেরিত দূত হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করেন। অনুপম শিষ্টাচার এবং মধুর স্বভাবের দ্বারা মহানবী তাঁর মহিয়সী সহধর্মিণীর কাছে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মহানবীর সহধর্মিণী হজরত আয়েশা তার মহান জীবনসঙ্গীকে বর্ণনা করেন কুরআনের শিক্ষার প্রতিচ্ছবি বলে। আল কুরআন যে আদর্শ উপস্থাপনা করে, মহানবী ছিলেন তারই বাস্তুব দৃষ্টান্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিচারক হজরত আনাস বলেছেন, ‘আমি একাধারে তাঁর গৃহে ১০ বছর কাজ করেছি। দীর্ঘ এই ১০ বছর সময়ের মধ্যে তিনি কখনো আমাকে বলেন নাই, কেন এটা তুমি করলে অথবা কেন এটা করোনি।’ বাইবেলে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা যিশুখৃষ্ট এবং তার জীবন সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, আমরা যারা আল কুরআনে বিশ্বাসী, তারা সেই বিবরণ বিশ্বাস করি না। পবিত্র কুরআনের মতে, হজরত ঈসা পবিত্রতার মূর্তপ্রতীক এবং তিনি তার সঙ্গী-সাথীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সেন্ট ম্যানুসের বিবরণ মতে আমরা দেখতে পাই, যিশুখৃষ্টের শেষ ভোজনের ১২ জন সাথীর মধ্য থেকেও একজন যিশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং অবশিষ্টরা তাকে তার জীবনের শেষ রাতে মোরগ ডাকার আগেই একবার নয়, তিন তিন বার অস্বীকার করেন। ইসলামের মহান নবীর নিজস্ব শিষ্য-সাথী ছিলেন, ইতিহাসে যারা সাহাবা রূপে পরিচিত। সংখ্যায় তারা ১২ জন নয়, ১২ শতেরও বেশি। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবাদের কাছে নিজেকে গোপন করতেন না, বরং মানব জাতির কল্যাণে তিনি সাহাবাদের কাছে প্রদীপ্ত সূর্যের ন্যায় নিজের জীবনধারা উম্মুক্ত রাখেন। মহানবীর পুত-চরিত্রের ও ব্যক্তিত্বের এটা কি একটা বিস্ময়কর নিদর্শন নয়? মহানবীর কোনো সাহাবার মনে কস্মিনকালেও রাসূলুল্লাহ (সা.) কিংবা তাঁর কাজের সামান্যতম ক্ষতি সাধন করার চিন্তা উদয় হয়নি। মহানবীর প্রতি এমন ধরনেরই শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা ছিল সাহাবাদের। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, মহানবীর গুরুতর শত্রæ আবু লাহাব এবং আবু জেহেল, যারা চিরকাল তাঁর রক্ত-মাংস কামনা করেছে, এরূপ শত্রæরাও অন্তরে অন্তরে এই মহান শত্রæর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ না করে পারত না। একদা জনৈক বেদুঈন আবু লাহাবের কাছে কিছু সংখ্যক উট বিক্রয় করেছিল; কিন্তু আবু লাহাব বেদুঈনের প্রাপ্য পুরোপুরি পরিশোধ না করার বেদুঈন মহানবীর কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করে। মহানবী দরিদ্র বেদুঈনের অসহায়তায় ব্যথিত হয়ে আবু লাহাবকে বেদুঈনের পাওনা টাকা চুকিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। আবু লাহাব দ্বিরুক্তি না করে সাথে সাথে মহানবীর অনুরোধ মেনে নিয়ে বেদুঈনের টাকা পরিশোধ করে দেন। এসব ঘটনা মহানবীর মহত্বের উজ্জ্বলতম প্রমাণ। মহানবীর চরিত্রের এই অনুপম রূপমাধুর্যের জন্য পবিত্র কুরআনে মহানবীকে ‘উসওয়াতুন হাসানা’ অর্থাৎ মানব চরিত্রের অনুপম আদর্শ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ার।
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।
ধূলির ধরা বেহেশতে আজ
জয় করিল, দিলো রে লাজ;
আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়
দেখ আমিনা মায়ের কোলে
দোলে শিশু ইসলাম দোলে,
কচি মুখে শাহাদাতের বাণী সে শোনায় ....
নিখিল দরূদ পড়ে ল’য়ে ও নাম
‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম;
জিন-পরী, ফেরেশতা সালাম
জানায় নবীর পা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন