শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মাওলানা এম এ মান্নান ও তাঁর বহুমুখী প্রতিষ্ঠান

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৫ এএম

‘মর্দে পেদীদ আমদ অ কারে বকুনাদ’, অর্থাৎ এক ব্যক্তি আত্মপ্রকাশ করে এবং কিছু কাজ করে যায়। হজরত শেখ সাদি রহ. এর এ উক্তি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ব্যক্ত হয়ে থাকে। আর এ রূপ ব্যক্তিত্বকে বলা হয় ক্ষণজন্মা পুরুষ, সচরাচর যাদের জন্ম হয় না। আলহাজ¦ মাওলানা এম এ মান্নান রহ. ছিলেন এ শ্রেণির এক বিরল ব্যক্তিত্ব। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, বহুগুণে গুণান্বিত, ঐতিহ্যময়, বহু সুকীর্তির ধারক-বাহক ও প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নান রহ. কেবল ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে বছরে এক বার স্মরণ করে নৈতিক দায়িত্ব বোধের গর্বে নিজেকে গর্বিত মনে করা যায় এবং আত্মতৃপ্তিও লাভ করা যায়, কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। গণনার দিক থেকে মাওলানা মরহুমের সুকীর্তির তালিকা দীর্ঘ না হলেও তার প্রতিটি কীর্তি এক একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানই বহন করতে পরে। এভাবে হিসেব করলে দেখা যাবে, গাউসুল আজম মসজিদ কমপ্লেক্স, দৈনিক ইনকিলাব তারই প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের তিন দশক ধরে একাধারে সভাপতি হিসেবে এ সংগঠনের নবরূপ দাতা। তিনি এ সকল কীর্তিময় প্রতিষ্ঠানের জন্মদাতা। এগুলোর সাথে নানাভাবে জড়িত, তথা কর্মকর্তা-কর্মচারী, খাদেম-সেবক প্রভৃতি শ্রেণির লোকের সংখ্যা বিপুল। দেশ, জাতি ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তাদের ব্যক্তি জীবনকে সুন্দর স্বাবলম্বি করে তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছেন এবং অনেকের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগও হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের সুবাদে।

পীর পরিবারের সুযোগ্য কীর্তিমান সন্তান হিসেবে মাওলানা এম এ মান্নান রহ. গতানুগতিক পীর মুরিদী করতেন না, কিন্তু তিনি হক্কানী শরীয়তপন্থী পীর-মাশায়েখ ও আলেমভক্ত ছিলেন। তিনি তরিকা চতুষ্টয়ের সকল সিলসিলার পীর-মাশায়েখের ভক্ত ছিলেন। বিশেষত কাদেরিয়া তরিকার প্রতি তার ভক্তি-অনুরাগের নিদর্শন স্বরূপ তিনি হজরত গাউসুল আজম রহ. কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মসজিদে গাউসুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা আধুনিক নির্মাণ শৈলীর দিক থেকেও এক অপূর্ব ইমারত এবং দেশের ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি জীবদ্দশায় সুস্থ থাকা অবস্থায় প্রায় তিন দশক নিয়মিত খতীব হিসেবে সাপ্তাহিক জুমাপূর্ব ঐতিহাসিক খুতবা প্রদান করেন। প্রচলিত রাজনীতি বর্জিত এসব খুতবা ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা, কোরআন হাদীসের আলোকে সঠিক তথ্যনির্ভর এবং যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের ভিত্তিতে প্রদত্ত হতো।

মসজিদে গাউসুল আজমের নানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এ মসজিদে রমজান মাসব্যাপী ‘কিয়ামুল লাইল’ প্রবর্তন করা মাওলানা এম এ মান্নান রহ. এর অপূর্ব কীর্তি। তারাবীহর নামাজে প্রচলিত খতমে কোরআন ছাড়াও সেহরী পূর্ব ‘কিয়ামুল লাইল’ অনুষ্ঠানে কোরআন খতম করার এ নিয়ম বাংলাদেশের কটি মসজিদে চালু আছে তা জানা নেই। ‘কিয়ামুল লাইল’ অনুষ্ঠানে হাফেজগণ নফল নামাজে কোরআন খতম করেন, তাতে আগ্রহী অনেক মুসল্লী অংশগ্রহণ করেন। যারা সময় হাতে করে আসেন তারা অতিরিক্ত নফলও আদায় করতে পারেন।

মাওলানা সাহেব কাদেরিয়া পাবলিকেশনস এন্ড প্রোডাক্টস লি. নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। দৈনিক ইনকিলাব এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে কিছু ধর্মীয় বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে, তবে মাওলানা মান্নান রহ. প্রকাশনার শুরুতেই পবিত্র কোরআনের প্রতিলিপি প্রকাশ করে সাধারণ তেলাওয়াতকারীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছিলেন। কোরআনের এ দুর্লভ খেদমত খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব। কোরআনের প্রতিলিপি ছাপিয়ে সে কপি বিনামূল্যে বিতরণের দৃষ্টান্ত বিরল।

প্রাথমিক পর্যায়ে পবিত্র কোরআন শিক্ষায় বিভিন্ন মকতব, ফোরকানিয়া মাদরাসার প্রচলন আমাদের দেশে বিশেষ ধর্মীয় ঐতিহ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও শিক্ষকদের জীবন মান উন্নয়নে মাওলানা এম এ মান্নান রহ. এর অবদান অনন্য। ইবতেদায়ী এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরকারি অনুদান বৃদ্ধির জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ইসলামের প্রাথমিক-মৌলিক শিক্ষার প্রাণ কেন্দ্র এসব প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে তিনি দ্বীনী শিক্ষার ভিত মজবুত করেছেন। তার পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, তিনি বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের দীর্ঘকালীন সভাপতি হিসেবে ধর্মীয় শিক্ষার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোর ‘খায়ের খাহির’ মূল উদ্দেশ্য উত্তম রূপে জ্ঞাত ছিলেন। বিশেষত খ্রিস্টান মিশনারি ও এনজিওগুলোর কৌশলী তৎপরতার কারণে আমাদের দেশে ফোরকানিয়া মকতব-মাদরাসাগুলোর অস্তিত্ব অনেকটা যখন বিপন্ন, সে নাজুক পরিস্থিতিতে মাওলানা এম এ মান্নান রহ. এসব প্রতিষ্ঠানের পাশে এসে দাঁড়ান এবং সম্ভব্য সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা, অবদান বিস্মৃত হওয়ার নয়।

বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং তাদের জীবন মান উন্নয়নে মাওলানা এম এ মান্নান রহ. এর অবিস্মরণীয় ভ‚মিকা ও অবদানের কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তিনি জমিয়াত কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার-উন্নয়নে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি সমর্থন-সাহায্য আদায়ে সক্ষম হয়েছেন। তার সমর্থন ও সহযোগিতার ফলে বিভিন্ন স্তরের বহু মাদরাসা সরকারি অনুমোদন লাভ করে। ফলে দেশে সরকার অনুমোদিত মাদরাসার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

উদার নীতির অধিকারী মাওলানা এম এ মান্নান রহ. জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে বিভিন্ন মতাদর্শের আলেমদের সাথে ভদ্র আচরণ করতেন এবং কারো সাথে বৈরি আচরণ করতেন না। দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুসলিম দেশ ভ্রমণকালে তার সফর সঙ্গীদের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভিন্ন মত পোষণকারীদেরকেও সফরসঙ্গী করেছেন এবং বহু লোককে বিদেশ গমনের সুযোগ করে দিয়েছেন। দেশের কওমী মাদরাসাগুলোর সরকারি অনুমোদনের দাবির প্রতি মাওলানা এম এ মান্নান রহ. সব সময় সমর্থন জ্ঞাপন করতে থাকেন এবং এ শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন তিনি সব সময় কামনা করতেন।

শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন, সংস্কার ছাড়াও দেশে বিরাজমান সামাজিক অপরাধ, পাপাচার, কুসংস্কার, দুর্নীতি, মদ, জুয়া এবং ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতার বিরুদ্ধে মাওলানা এম এ মান্নান ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। তিনি জমিয়াতের পক্ষ হতে সকল অপরাধ, অপকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ নিন্দা করেছেন। কোরআন হাদীসের অবমাননাকারী এবং নবী-রসূলদের প্রতি ঘৃণ্য তৎপরতা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে মাওলানা এম এ মান্নান রহ. এর নেতৃত্বে এ সংগঠন সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীন দেশের অখন্ডত্ব ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত বানচাল করতে মাওলানা ও তাঁর সংগঠনের বলিষ্ঠ ভূমিকা অনস্বীকার্য।

দৈনিক ইনকিলাবের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নান রহ. বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে নব যুগের সৃষ্টি করে গেছেন, সে ব্যাপারে তার সুদূরপ্রসারী ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি একজন খাঁটি ধর্মীয় আলেম হয়েও আধুনিক প্রযুক্তির সংবাদপত্র প্রকাশ করে যে চমক সৃষ্টি করেন, তা রীতিমত অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশ-জাতির কল্যাণে এবং ইসলামের মহান শিক্ষাগুলো সমাজে ছড়িয়ে দেয়া ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে মাওলানা সাহেবের এরূপ উদ্যোগ, প্রয়াস, ইসলামের চর্চা-অনুশীলনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

সমাজকল্যাণমূলক তৎপরতায় মাওলানা এম এ মান্নান রহ. তাঁর জমিয়াত সংগঠনের মাধ্যমে নানা ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তাঁর সংগঠন ত্রাণসামগ্রী ও ওষুধপত্র নিয়ে দুর্গত ও উপদ্রুব এলাকায় পৌঁছে যেত এবং ক্ষতিগ্রস্ত গরীব-দুঃখী-অসহায়দের মধ্যে সাহায্য সামগ্রী বিতরণ করে মানবতার প্রতি সহায়তায় এগিয়ে আসার বহু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাঁর সেই সংগঠন আজো মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করে তাঁর আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছে।

একাধিকবার সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে মাওলানা এম এ মান্নান রহ. তাঁর প্রশংসনীয় ভূমিকার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন এবং সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হন। জাতীয় পর্যায়ে তিনি অর্পিত দায়িত্বের অধীনে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। মসজিদসমূহে বিদ্যুৎ-পানি সরবরাহ এবং বিল হ্রাস তার উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি জুমার খুতবা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যা সম্পন্ন করতে পারেননি।

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল মাওলানা এম এ মান্নান রহ. এর আজীবন সংগ্রাম-সাধনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু তিনি তার সে স্বপ্নকল্পনার বাস্তব রূপ দেখে যেতে না পারলেও তার যোগ্য উত্তরসুরি তা বাস্তবায়ন করে এক বিস্ময়কর রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। হজরত শেখ সাদী (রহ. এর ভাষায় বলতে হয়, ‘পেদার না তাওয়ানাদ কার্দ, পেসার তাওয়ানাদ কার্দ।’ অর্থাৎ ‘পিতা যা করে যেতে পারেননি, পুত্র তা করতে পেরেছেন।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন