আহমেদ জামিল
গত ১৮ নভেম্বর দেশের দ্বিদলীয় মূলধারার রাজনীতির অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর একটি হোটেলে ‘নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণে বিএনপির প্রস্তাবাবলী’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু করতে এই ১৩ দফার প্রস্তাব তুলে ধরেন। বিএনপির তরফ হতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে এই প্রস্তাবগুলো পাঠানো হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন এমন এক সময় নির্বাচন কমিশনে সংস্কার বিষয়ে প্রস্তাব করলেন যখন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে মাত্র কয়েক মাস বাকি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। বেগম জিয়ার প্রদেয় প্রস্তাব নিয়ে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি এবং নানা ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত ২১ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বিএনপির প্রস্তাব : প্রশ্ন ও প্রত্যাশা’ শিরোনামে এক উপসম্পাদকীয় কলামে বলেছেন, “বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে প্রধানত দুটো দিক রয়েছে। একটি নীতিগত অপরটি পদ্ধতিগত। তিনি নীতিগতভাবে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনে রাখার কথা বলেছেন। এই নীতির সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই।” যাহোক, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের অন্যতম নীতিগত দিক হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনে এবং কমিশন গঠন করার জন্য বাছাই কমিটিতে নিয়োগ সংক্রান্ত। বেগম জিয়া এক্ষেত্রে তার প্রস্তাবে নিরপেক্ষ, সৎ ও অভিজ্ঞ এবং প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছেন।
তবে প্রবল রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত আমাদের সমাজে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন সৎ, নিরপেক্ষ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। তারপরও বলতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সবার অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ ধরনের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন শুধু অপরিহার্যই নয়, সময়ের দাবিতেও পরিণত হয়েছে। বিএনপি নেত্রী এ ক্ষেত্রে পথও বাতলে দিয়েছেন। তিনি অবসরের পর লাভজনক পদে থাকা বিচারপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরি করা সরকারি কর্মকর্তাদের কমিশনে বাছাই কমিটিতে নিয়োগ না দিতে বলেছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এ ধরনের সুপারিশকে বাস্তবোচিত বলেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব মতে, নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রাথমিকভাবে প্রস্তাব করবে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের প্রেরিত নামগুলো থেকে বাছাই কমিটি নির্বাচন কমিশনের পাঁচজন সদস্য নিয়োগের জন্য ১০টি নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করবে। রাষ্ট্রপতি এর মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং বাকি চারজনকে কমিশনার পদে নিয়োগ দেবেন। বেগম জিয়ার এহেন প্রস্তাব অযৌক্তিক নয় মোটেই। এ ধরনের উদাহরণ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশেই রয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালে সরকারি ও বিরোধী দলগুলো ঐকমত্যের ওপর ভিত্তি করে তথা যৌথভাবে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের মনোনয়ন করেন। রাষ্ট্রপতি তাতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১. প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ের প্রণীত বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন। ২. একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া নির্বাচন কমিশন গঠিত হইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাহার সভাপতি রূপে কার্য করিবেন। ৩. এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ তাহার কার্যভার গ্রহণের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসরকাল হইবে। ৪. নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীনে থাকিবেন।
উল্লিখিত দিক বিবেচনা করে বলতে হয়, নির্বাচন কমিশন শুধু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানই নয়, এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে শুরু করে সকল সদস্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকবেন। তার বর্তমান প্রেক্ষাপটের বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের কারো কারো অভিমত হলো, বর্তমান সরকার চাইলে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদানের জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু সরকারের এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও চায় নির্বাচন কমিশনে পছন্দের ব্যক্তিদের বসিয়ে যে কোনোভাবে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করা। চলমান প্রক্রিয়ায় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদান করেন রাষ্ট্রপতি। আর রাষ্ট্রপতির নিয়োগদানের অর্থ কার্যত সরকার প্রধানের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করা।
এর আগেও দেখা গেছে, আইওয়াশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে যে সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয় তা কখনোই নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারেনি। কারণ যাদের নিয়ে এই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়, তারা ছিলেন সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী। ফলে এই ধরনের অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের পক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে ভূমিকা পালন করা কঠিন। আর এ বাস্তবতার নিরিখে বিএনপি চেয়ারপারসন অনুসন্ধান বা বাছাই কমিটিতে নিরপেক্ষ, সৎ, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগদানের সুপারিশ করেছেন। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন এবং দায়িত্ব পালনরত সেনাকর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সুশীল সমাজের অনেকেই বেগম জিয়ার সেনা নিয়োগ ও বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। তবে অতীত অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় সেনা মোতায়েন এবং তাদেরকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাবকে অনেক বেশি যুক্তসঙ্গত বলেই মনে হয়।
কারণ রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশ, র্যাব ও সীমান্তরক্ষী বিজিবি নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। শুধু সেনাবাহিনীই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার নিরপেক্ষ চরিত্র এখনও বজায় আছে বলে জনগণ মনে করছে। তাই মনে রাখতে হবে, নির্বাচনকেন্দ্রিক এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতে যে কোনো সহিংস আন্দোলন, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেশের নিরাপত্তাও বিঘিœত করে থাকে। তাই এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিহার্য। এদিকে এ কথাও সত্য যে, যে কোনো নির্বাচন কমিশনের সাফল্য নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছার ওপর। সরকার নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন করতে দিলে নির্বাচন যে অনেকখানি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে তার প্রমাণ হিসেবে অতীতের সকল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা যেতে পারে।
দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ এর জাতীয় সংসদের নির্বাচন থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে রকিবউদ্দীনের অধীনে নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত ভূমিকার কথা দেশবাসী ভালোভাবেই জ্ঞাত। এরই সূত্র ধরে এ কথাও বলা যায় যে, বিএনপি চেয়ারপারসন নিকট অতীতে বেশ কয়েকবার শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে যে মন্তব্য করেছিলেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাঁর সাথে একমত পোষণ করে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়রের পদ যেভাবে ত্যাগ করেছেন, জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মহত্বের পরিচয় দিতে পারেন।
নির্বাচন কমিশনের সংস্কার সংক্রান্ত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব আওয়ামী লীগ খারিজ করে দিলেও এবং আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা সমালোচনামুখর হলেও বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে দেশের বেশির ভাগ জনগণের কাছে তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন পেয়েছে। তাই জনগণের প্রত্যাশা, প্রকৃত ও টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে শেখ হাসিনা সরকারের উচিত নির্বাচন কমিশন সংস্কার নিয়ে বেগম জিয়ার প্রস্তাবের প্রতি সাড়া দিয়ে বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপে বসা এবং ঐকমত্যে আসার জন্য আন্তরিক প্রক্রিয়া চালানো। এই আন্তরিক প্রয়াস শুধু সরকার নয়, বিরোধী দলগুলোর তরফ হতেও চালাতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন