শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

নাসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হোক

| প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর : আজ ২২ ডিসেম্বর, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং নগরীর ওয়ার্ড সমূহের কাউন্সিলর নির্বাচনের ভোট। একই সাথে মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্যও ভোট। স্বাভাবিকভাবেই নারায়ণগঞ্জ এখন ভোটের জনপদ। জনগণের কাছে নিজেদের যোগ্যতা এবং প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতে প্রার্থীদের একটুও অবসর ছিল না গত এক মাস। দিন রাত তারা কেবল জনগণের কাছে ছুটেছেন। পাশাপাশি ভোটের হিসাব নিকাশ নিয়ে জনগণের ব্যস্ততারও কোনো শেষ নেই। শুধু তাই নয় নারায়ণগঞ্জের এই নির্বাচনই এখন সারা দেশের প্রধান আলোচিত বিষয়। মেয়র পদে কে বিজয়ী হবেন তা নিয়ে যেমন চলছে বিশ্লেষণ, ঠিক তেমনি কাউন্সিলর হিসাবে কারা বিজয়ী হবেন, তা নিয়েও চলছে হরেক রকম হিসাব নিকাশ। তবে বিচার বিশ্লেষণ যাই হউক না কেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক ব্যক্তিদের বিজয়ই আমাদের প্রত্যাশা। এই নির্বাচনে ধর্ম বর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির সকল পেশার মানুষের ভোটাধিকার যেমন নিশ্চিত করতে হবে, ঠিক তেমনি দেশ এবং জাতির স্বার্থে সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তিদেরকেও বিজয়ী করতে হবে। আর জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই নির্বাচন অতীতের সকল নির্বাচনের চেয়ে সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ হবে- এটাই যেমন আমাদের প্রত্যাশা, ঠিক তেমনি নারায়ণগঞ্জ শহরের সর্বস্তরের ভোটারবৃন্দ তাদের ভোটাধিকার যথাযথ প্রয়োগ করে এই শহরের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন- এটাও আমাদের কামনা। তবে জনগণের রায়ে যেই বিজয়ী হউক না কেন, সেই ফলাফল সবাইকে হাসিমুখে মেনে নিতে হবে। কোনো ধরনের হানাহানি নয় বরং ভোট যেন একটি উৎসব হয়। আর এটাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
বরাবরের মতই এই নির্বাচনে এবারো মেয়র পদের লড়াই প্রধানত দুই ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এটি একটি স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন হলেও, এই নির্বাচন রাজনৈতিক পরিচয়েই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিচয়েই প্রার্থীরা পরিচিত হচ্ছে এবং রাজনৈতিক প্রতীক নিয়েই প্রার্থীরা নির্বাচনে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী এবং তিনি নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করছেন। অপরদিকে সাখাওয়াত হোসেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এবং ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করছেন। অর্থাৎ নাসিক নির্বাচন এখন পরিণত হয়েছে, আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি’র নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মধ্যেই মূলত এই লড়াই।
ঢাকার পাশেই অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ একটি শিল্প শহর এবং দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র। স্বাভাবিকভাবেই নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন, অগ্রগতি, শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সমৃদ্ধ অর্থাৎ যোগ্য নেতৃত্ব। একটি জনপদের উন্নয়ন, শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সৎ নেতৃত্বের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। একইভাবে সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে একটি জনপদের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে হলে যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সুতরাং নারায়ণগঞ্জ শহরের উন্নয়ন, শান্তি এবং নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হলে এই শহরের ভোটাদেরকে আজ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যথাযথ প্রার্থীকে ভোট প্রদানের মাধ্যমে আগামী দিনের শাসক নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত তাদের এবং দেশের অবস্থার উন্নয়নে যেমন বিরাট ভূমিকা রাখবে, ঠিক তেমনি ভুল সিদ্ধান্ত নিজেদের পাশাপাশি দেশের জন্যও অধঃপতন নিয়ে আসতে পারে।
আমরা সবাই গণতন্ত্র এবং জনগণের ভোটাধিকারের কথা বললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা এখনো বাস্তবতা বর্জিত। তাই এখনো নির্বাচন হলে সেখানে জাল ভোট প্রদান এবং ভোট কেন্দ্র দখলের চিত্র দেখা যায়। অনেকে এখনো বিপক্ষ দলের সমর্থক মানুষদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ভোট প্রদান থেকে বিরত রাখতে চায়। এসব কিন্তু গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের পরিপন্থী। আমরা এসবের চিরতরে অবসান চাই। আমরা চাই প্রতিটি মানুষ নির্ভয়ে ভোট প্রদানের অধিকার লাভ করুক এবং নির্ভয়ে তার পছন্দনীয় ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করুক। আর জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাটা কিন্তু গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই, যেটি হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ। এ জন্য নির্বাচনে সকল প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তার জন্য প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কোনো ধরনের সন্ত্রাস এবং সহিংসতা আমরা চাই না। আমরা চাই নির্বাচন পরবর্তী সময়েও বিজয়ী এবং পরাজিত উভয় ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক। আমরা চাই সকলের শান্তি পূর্ণ সহাবস্থান এবং দেশকে এগিয়ে নিতে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ। আর এসব নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই সবার আগে গণতন্ত্রের অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। নির্বাচন কমিশনকে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সাথে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ করার স্বার্থে যা কিছু করা সম্ভব সব কিছুই করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। আমরা আশা করবো নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করবেন এবং জাতিকে একটি সুষ্ঠু এবং সফল নির্বাচন উপহার দিবেন। আর নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে হাসিমুখে মেনে নেয়াটাই কিন্তু গণতন্ত্রের মূল কথা এবং সভ্যতার পরিচায়ক। জনগণ যদি ভোটের মাধ্যমে কাউকে প্রত্যাখান করে, তাকে হাসিমুখে মেনে নেয়াটাই কিন্তু গণতন্ত্রের মূলনীতি।
দেশে এখন রাজনৈতিক সংকট চলছে। সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখন দেশ শাসন করছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করায়, এই নির্বাচনের প্রতি জনগণের আগ্রহ কম ছিল এবং জনগণের অংশগ্রহণও ছিল কম। ৩০০ আসনের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে নির্বাচন হয়নি। এসব আসনে প্রার্থী ছিলেন মাত্র একজন। ফলে এসব প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের আগেই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। অপরদিকে যেসব আসনে নির্বাচন হয়েছে প্রার্থী সংখ্যা কম থাকায় সেসব এলাকায়ও নির্বাচনের তেমন কোনো আবহ সৃষ্টি হয়নি। ১৪৭টি আসনে মাত্র ৫৪৩ জন প্রার্থী অংশগ্রহন করে। আর নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মাঝে মাত্র ১২টি দল অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমান সংসদে বেগম রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেত্রী হিসাবে অভিহিত হলেও দেশি-বিদেশি কারো কাছেই সেটা গুরুত্ব পাচ্ছে না, এমনকি তার দল জাতীয় পার্টি নিজেদেরকে বিরোধী দল হিসাবে পরিচিতি দিলেও, জাতীয় পার্টি মূলত সরকারেরই অংশ। জাতীয় পার্টির লোকেরা সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য। এ ধরনের রাজনীতি স্বল্প মেয়াদে সফলতা আনলেও, দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য এবং জনগণের জন্য অকল্যাণই বয়ে আনে। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার জোট অংশগ্রহণ না করায় রাজনৈতিক সংকট না কমে বরং বেড়েছে। এ অবস্থায় দেশের প্রধান একটি শহরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিএনপি জোট সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও স্থানীয় সরকার র্নিবাচনে অংশগ্রহণ করেছে। সুতরাং এই নির্বাচনকে অবশ্যই সুষ্ঠু হতে হবে এবং এতে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে নির্বাচনে জনগণ যত বেশি ভোট প্রদান করেন, সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও তত বেশি।
পরিশেষে দেশের একজন সচেতন এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে নারায়ণগঞ্জ সিটির সম্মানিত ভোটারদের প্রতি একটি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা প্রত্যেকে অবশ্যই নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যাবেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিবেন। মনে রাখবেন, ভোট একটি পবিত্র আমানত এবং সম্পদ। সঠিক ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করে নেতৃত্ব নির্বাচন করাটা একজন নাগরিকের জাতীয় দায়িত্ব। তাই অবহেলা করে আপনার মূল্যবান ভোটাধিকারটা নষ্ট করবেন না। ভোটাধিকার প্রয়োগ না করা মানে জাতির প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন না করা। আর শুধু নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে চলবে না বরং অন্যদেরকেও ভোট প্রদানে উৎসাহিত করতে হবে। একই সাথে কেউ যদি আপনার ভোটাধিকার হরণ করতে চায় তাহলে নির্বাচন কমিশনার, প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করুন। তবে পরিস্থিতি যাইহোক কখনই নিজের হাতে আইনকে তুলে নিবেন না। কারণ নিজের হাতে আইন তুলে নিলে সমাজে কখনোই শান্তি আসে না, বরং অশান্তির সৃষ্টি করে। ভোট দেয়ার আগে কাকে ভোট দিবেন তা নিয়ে শতবার চিন্তা করুন। আবেগ দিয়ে নয়, বরং বিবেক দিয়ে প্রার্থী যাচাই বাচাই করুন। তারপর আপনার ইচ্ছানুযায়ী আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিন। কিন্তু কখনই অর্থের বিনিময়ে নিজের ভোটকে বিক্রি করবেন না। একইসাথে সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখবেন না। আর আইডি কার্ডটা সঙ্গে নিতে কখনো ভুল করবেন না। তবে অনুগ্রহ করে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ এবং অপেক্ষাকৃত অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করে নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন না। যদি করেন তাহলে সমাজের নেতৃত্ব অসৎ এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতেই অর্পিত হবে। আর তাদের শাসনে সমাজে শান্তি নয়, বরং অশান্তিই সৃষ্টি হবে এবং সময়ের সাথে সাথে তা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন এবং সঠিক ব্যক্তিকে আপনাদের নেতা নির্বাচন করুন। আসুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করি এবং একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং অবকাঠামো নির্মাণ করি। যার মাধ্যমে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে আমার প্রিয় বাংলাদেশ। পরিশেষে আবারো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের সফলতা কামনা করছি এবং সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক ব্যক্তিদের বিজয় কামনা করছি।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Kamal ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৩৮ এএম says : 0
ata e sokoler asa
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন