শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

নাসিক নির্বাচন থেকে বিএনপির লাভ-ক্ষতি

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন : বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২২ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে। দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণকারী নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করে মেয়র পদে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। ডা. আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট। বিপরীতে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। ব্যবধান ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোট।
বিশাল এ ব্যবধান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের ইঙ্গিত দেয় কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, জাতীয় নির্বাচনী-প্রতীকে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের ফলাফলে ভোটারদের মধ্যে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অবস্থানের প্রতিফলন ঘটবে এমন কথা অনেকেই বলেছিলেন। বিশেষত, বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, যারা নারায়ণগঞ্জ সফর করেছিলেন বা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তাদের কথাবার্তায় এ বিষয়টি প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল। তারা অনেকেই বলেছিলেন যে, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনেই প্রমাণ হবে জনগণ কোন দলকে চায়। তারা এও বলেছিলেন যে, এ নির্বাচনের মাধ্যমেই নারায়ণগঞ্জবাসী এ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাবে। তারা বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জে ধানের শীষের ঢেউ উঠেছে এবং সে ঢেউ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তো তাদের কথার সারমর্ম অনুযায়ী এখন যদি বলা হয়, দেশে বিএনপির জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগের তুলনায় অর্ধেক, তাহলে কি খুব একটা ভুল হবে? যদিও বাস্তব পরিস্থিতি তেমনটি নয়।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমে আইভীর বিজয়ী হওয়ার নেপথ্য কারণগুলো আলোচনা করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়টি এখানে সহৃদয় পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। গত ১৩ ডিসেম্বর আমি নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি এলাকা ঘুরেছি। কথা বলেছি সাধারণ ভোটার, পেশাজীবী, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে। তাদের স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট বক্তব্য মন্তব্য থেকে আমার যেটা মনে হয়েছিল পাঁচটি কারণে আইভী জিতে যাবেন। এক. নারায়ণগঞ্জের সাধারণ ভোটাররা (উভয় দলের কর্মী ব্যতীত) নির্বাচনটিকে স্থানীয় নির্বাচন হিসেবেই নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রতীককে তারা গুরুত্ব দেয়নি। ফলে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভী সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ভোটারদের সমর্থন পাবেন। দুই. মহিলা ভোটারদের মধ্যে আইভীর ভাবমর্যাদা আকাশ ছোঁয়া, ফলে আইভী তাদের ভোট একচেটিয়া পাবেন। তিন. নারায়ণগঞ্জের একটি প্রভাবশালী আওয়ামী পরিবারের সন্ত্রাস ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি গত কয়েক বছর সাহসের সঙ্গে আপসহীন লড়াই করেছেন। তাতে জনমনে তার একটি বিশাল ভাবমর্যাদা রয়েছে। চার. নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করে প্রভাবশালী ওই গ্রুপটির বিরুদ্ধে একমাত্র আইভীই হতে পারেন তাদের ভরসাস্থল, তাই তারা দলীয় প্রতীক বাদ দিয়ে আইভীর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। পাঁচ. স্থানীয় আওয়ামী লীগের আইভী বিরোধী নেতা-কর্মীরাও দলীয় ও ইমেজ ও ইজ্জতের কথা ভেবে মনের দুঃখ মনে চেপে একাট্টা হয়ে আইভীর পক্ষে কাজ করেছেন। সে সাথে পৌর ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দীর্ঘ তের বছর তিনি যেসব কাজ করেছেন, তাও ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে তার জন্য।
অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন অনেকটাই লো প্রোফাইলের নেতা। তার একমাত্র পরিচয় চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী হওয়া। অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি হলেও রাজনীতিতে বা সংগঠনে তেমন সক্রিয় ছিলেনÑএমন প্রমাণ নেই। অবশ্য একজন ভদ্র মানুষ হিসেবে আইনজীবী মহল ও জানাশোনা পরিধিতে তিনি পরিচিত ছিলেন। তবে, নারায়ণগঞ্জের মতো মহানগরের নির্বাচনে ওই পরিচিতি তেমন ঢেউ তুলতে পারার কথা নয়।
নারায়ণগঞ্জ সিটির এ নির্বাচনটি ছিল দেশের সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে। পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য ছিলÑ এ নির্বাচনের ওপর দেশের ভবিষ্যত রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বহুলাংশে নির্ভর করছে। নির্বাচনে যদি অনিয়ম, কারচুপি বা বিশৃঙ্খলা হতো, তাহলে বিএনপি সেটা ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পারতো। বিশেষত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং আগামী নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তারা কথা বলার আরেকটা সুযোগ পেতো। কিন্তু নির্বাচন এতটাই সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে যে, এ নিয়ে এখন আর প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকল না। কেননা, বিএনপি প্রার্থীও ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর গণমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। ফলে অতীতে যা-ই ঘটে থাকুক, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সরকার হস্তক্ষেপ করেনি। নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন শক্ত হাতেই নির্বাচন পরিচালনা করেছে। মনে রাখা দরকার, এ নির্বাচনটিই ছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সর্বশেষ বড় নির্বাচন। তারা শেষ নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ প্রবাদের প্রতিফলন হয়তো ঘটাতে চেয়েছে। কিন্তু কুঠারের কোপের দাগ যেমন রানদা’য়ের ঘঁষায় যায় না, তেমনি বিগত ইউপি, উপজেলা, পৌর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে তাদের ব্যর্থতার দাগও কখনো মুছে যাবে না।
এটা পরিষ্কার যে, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল এখান থেকে যতটুকু সম্ভব ফায়দা হাসিলের চেষ্টায়রত ছিল। বিএনপি প্রথম থেকেই এ নির্বাচনটিকে ‘জাতীয় ইস্যু’ বানানোর চেষ্টায় নেমেছিল। তাদের চিন্তা-ভাবনা ছিল যদি আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে পরাজিত করা যায়, তাহলে জাতির সামনে বলা যাবে, এ সরকারের জনপ্রিয়তা বলতে আর কিছু নেই। আর যদি নির্বাচনে সরকারি দল সন্ত্রাস করে, কারচুপি হয়, তাহলে তারা জনগণকে বলতে পারবে, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকল্পে দলটির দেয়া প্রস্তাবনা অধিকতর গ্রহণযোগ্য ভিত্তি পাবে। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের সময়ে তত্ত্বাবধায়ক না হলেও একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে যৌক্তিক বলে প্রমাণ করা যাবে। বলা নি®প্রয়োজন, নারায়ণগঞ্জের সুষ্ঠু নির্বাচন এবং তাতে বিএনপি প্রার্থীর পরাজয় দলটির পূর্বপরিকল্পনা বা চিন্তা-ভাবনাকে এলোমেলো করে দিয়েছে।
পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। এক ঢিলে তারা তিন পাখি শিকার করে মানসিক প্রশান্তিতেই আছে বলা যায়। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় তারা গলা উঁচিয়ে বলতে পারছে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে না, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ, আর বিএনপির জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে এবং তা এখন আওয়ামী লীগের অর্ধেক। যদিও একটি নগরীর মেয়র নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটার হিসাবে কাজ করে না।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে হেরে যাওয়ার পর বিএনপিতে যে হতাশা নেমে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত যে সাত খুনের ঘটনাকে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছিল, সে খুনের ঘটনাস্থলে সে সরকারের প্রার্থীর বিপুল ভোটে জিতে যাওয়া বিএনপির জন্য একটি বড় রকমের ধাক্কা সন্দেহ নেই। বিশেষত ওই হত্যা মামলার বাদী পক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন বিএনপির প্রার্থী। সঙ্গত কারণেই বিএনপি ধরে নিয়েছিল, সাধারণ জনগণ অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনকেই সমর্থন করবে। পাশাপাশি দলটির মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস-চেয়ারম্যান, যুগ্মমহাসচিবসহ নানা স্তরের নেতারা যেভাবে মাসব্যাপী প্রচার চালিয়েছিলেন, তাতে তারা বিজয় সুনিশ্চিত বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব নারায়ণগঞ্জবাসীর মনোভাবের পালস্ ঠিকমত ধরতে পারেননি। তারা বুঝতেই পারেননি যে, নারায়ণগঞ্জবাসী এ নির্বাচনকে স্থানীয় নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করেছে। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে এটাকে মেলাতে যায়নি। ফলে দলমত নির্বিশেষে ভোটাররা আইভীকে ভোট দিয়েছে।
এখন কথা হলোÑ এ নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলার কথা নয়। কিন্তু এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে জাতীয় রাজনীতির মাপকাঠি বানিয়েছে বিএনপি। তারা আগে থেকেই এ নির্বাচন এবং এর ফলাফল সম্বন্ধে এমনসব মন্তব্য করে আসছিল যে, মনে হচ্ছিল বিজয় সম্পর্কে তারা শতভাগ নিশ্চিত। তাই তারা ওই নির্বাচনের পর সরকারের গদী নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার বা আগামী সংসদ নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির আগাম বার্তা ছড়ানো শুরু করেছিল।
এদিকে নির্বাচনের পরদিন বিএনপি তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নাসিক নির্বাচনে বিএনপির প্রধান সমন্বয়কারী ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ‘মিডিয়া ক্যু’ হয়েছে। নির্বাচনটা ফেয়ার, ফলাফলটা আনফেয়ার। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ, গণনা ফলাফল ইত্যাদি বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য ‘জোর দাবি’ জানিয়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে বিএনপি নেতাদের প্রতিক্রিয়া খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। কেননা, যে ধরনের সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সব প্রার্থীর এজেন্টদের সামনে ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে স্থূল বা সূক্ষ্ম কোনো ধরনের কারচুপিরই সুযোগ ছিল না। ফলে বিএনপির অভিযোগকে গতানুগতিক বলেই ধরে নেয়া যায়।
অপরদিকে গত ২৩ ডিসেম্বরের পত্রিকাগুলোর খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচনে ধানের শীষের এ ভরাডুবির জন্য স্থানীয় তিন শীর্ষ নেতার নিষ্ক্রিয় ভূমিকাকে দায়ী করেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তারা বলেছেন, সাবেক এমপি আবুল কালাম ও গিয়াস উদ্দিন কাউন্সিলর প্রার্থী নিজেদের ছেলেদের এবং জেলা বিএনপির সভাপতি ও গতবারের মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার কাউন্সিলর প্রার্থী তার ভাইয়ের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মেয়র প্রার্থীর পক্ষে তাদের তৎপরতা কার্যত ছিল না। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএনপি নেতৃত্ব এ নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ পর্যালোচনা করবে, নাকি সরকারের ‘সূক্ষ্ম’ কারচুপির ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করবে তা আমাদের জানা নেই। তবে, পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। বিএনপি নেতৃত্ব যদি ভালো করে ‘নাসিক’ নির্বাচনে তাদের কর্মতৎপরতার দিকে পেছন ফিরে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন ভুলগুলো কোথায় হয়েছিল। প্রথমত প্রার্থী মনোনয়ন ঠিক হয়নি। আইভীর মতো জাঁদরেল প্রার্থীর বিপরীতে যে ধরনের সবল প্রার্থী দেয়া দরকার ছিল, বিএনপি তা দিতে পারেনি। প্রার্থী এতটাই দুর্বল ছিল যে, সে তার নিজ কেন্দ্রেও পরাজিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত স্থানীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে দু’চার বার দলের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ছবিতে দেখা গেলেও ভোট সংগ্রহের জন্য যে ধরনের তৎপরতা দরকার তারা সেটা করেনি। লক্ষণীয় হলো, ওই নেতাদের ভাই ও ছেলেরা কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করলেও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে দলের মেয়র প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ওই তিন নেতা নিজেদের স্বজনদের জন্য যতটা তৎপর ছিলেন, মেয়রের জন্য ততটা ছিলেন না। তাছাড়া ২৭টি কাউন্সিলর পদের মধ্যে ১২টিতে বিএনপি সমর্থক প্রার্থী জয়লাভ করলেও মেয়র পদে বিশাল ব্যবধানে পরাজয় প্রচার ও ভোট সংগ্রহের কাজে সমন্বয়হীনতারই প্রমাণ বহন করে। আর ঢাকা থেকে যারা গিয়েছিলেন তারা কেবল ‘বরযাত্রী’র মতোই শোভা বর্ধনের কাজ করেছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা দল বেঁধে গিয়েছেন, নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে রাস্তায় হেঁটেছেন, সালাম-কুশল বিনিময় করেছেন, আর সবশেষে একটি পথসভায় গরম বক্তৃতা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। বলা নি®প্রয়োজন, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে এ ধরনের শো’ডাউনের প্রভাব বা কার্যকারিতা খুবই কম। বরং এসব নির্বাচনে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট প্রার্থনাই জয়-পরাজয়ে অন্যতম নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এমনো দেখা গেছে, আইভীর কর্মীরা যে বাড়িতে ভোটের জন্য চার বার গিয়েছে, বিএনপির কর্মীরা সে বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত মাড়ায়নি। প্রকৃতপক্ষে, ঢাকার নেতারা ওখানে গিয়ে স্থানীয় নেতাদের কাজকর্মে আরো বিঘœ সৃষ্টি করেছেন। কারণ, তারা যখনই গিয়েছেন প্রার্থীসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে কেন্দ্রীয় নেতাদের অভ্যর্থনা আপ্যায়নে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার মোবিলাইজেশনে গুরুত্বহীন এসব লোককে কেন সেখানে পাঠানো হয়েছিল, সেটা একটি বড় প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি যদি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ রাখতো, জাতীয় রাজনীতির ইস্যুর সঙ্গে মেলাতে না চাইতো, তাহলে জয়-পরাজয় যাই হোক, রাজনৈতিক ক্ষতিটা কম হতো। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব এতটাই ‘ওভার কনফিডেন্ট’ ছিল যে, তারা জোর গলায়ই বলেছিল ধানের শীষের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না এবং এর মধ্য দিয়েই সরকারের জনপ্রিয়তায় ধসের বিষয়টি প্রমাণিত হবে। এমনকি দলের চেয়ারপার্সনকে দিয়ে এমনসব বিবৃতি দেয়ানো হয়েছে, যা একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তার দেয়াটা শোভনীয় ছিল না। ভাগ্য ভালো বেগম জিয়া নারায়ণগঞ্জে যাননি। তিনি সেখানে গেলে আওয়ামী লীগ এখন তারস্বরে চিৎকার করে বলতো-চেয়ারপার্সন নিজে এসেও তার দলের প্রার্থীকে জেতাতে পারেননি; জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা এমনই।
বিএনপি এ নির্বাচনে ব্যাপক লোকসান গুনলেও একটি দিকে তাদের কিঞ্চিৎ লাভ হয়েছে। সেটা হলোÑ দীর্ঘদিন দলটির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারছিল না। এ নির্বাচন উপলক্ষে তারা বাইরে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ পেয়েছে। বিপর্যস্ত বিএনপির জন্য এটিও কম প্রাপ্তি নয়। সে সঙ্গে আছে ১২ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর জয়লাভ। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে এই হলো বিএনপির নীট লাভ।
পক্ষান্তরে এ নির্বাচন থেকে সরকার তথা আওয়ামী লীগ একসঙ্গে অনেক লাভ করেছে। তারা এখন বলতে পারবে সরকারের জনপ্রিয়তা বিএনপির তুলনায় দ্বিগুণ। বিগত দিনের ‘ভুল রাজনীতির’ কারণে সাধারণ মানুষ বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এজন্য দলীয় কর্মীদের ভোটই শুধু পেয়েছে বিএনপির মেয়র প্রার্থী। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের উদাহরণ হিসেবে ২০১৩ সালের পাঁচটি সিটি নির্বাচনের সাথে নারায়ণগঞ্জকেও এখন যোগ করবে।
যে কোনো ঘটনায় লাভ-ক্ষতি থাকবেই। নির্বাচনেও একদল হারে একদল জেতে। আর সেসব হারজিতের পেছনে কিছু না কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে। বিজয়ী শিবিরে জয়ের কারণ নিয়ে তেমন পর্যালোচনা সাধারণত হয় না। কেননা, তারা তখন জয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা থাকে। তবে পরাজিতদের প্রধান কাজ হলো পরাজয়ের কারণগুলো অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পন্থা অবলম্বনের নীতিমালা তৈরি করা। বিএনপির এখন সে কাজটিই করা দরকার। কিন্তু দলটির নেতৃত্ব তা করবে এমন সম্ভাবনা খুব কম। কেননা, তাতে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ নেতাদের কাজকর্মের থলের বিড়াল বেরিয়ে যেতে পারে, যাতে অনেকেরই মুখ মলিন হওয়ার আশঙ্কা আছে। তারা হয়তো ‘গভীর পর্যালোচনা’ করে ‘অতীব সূক্ষ্ম কারচুপি’র তত্ত্বই জনসমক্ষে হাজির করবেন। বলাই বাহুল্য, তাতে আদতে কোনো লাভ হবে না। বরং তা চামড়ার নিচে ঘা জিইয়ে রেখে ওপরে মলমের প্রলেপ দেয়ারই নামান্তর হবে। যা ঘা’কে নির্মূল না করে ধীরে ধীরে আরো বিস্তার লাভ করার সুযোগ করে দিতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন