শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ইসলামের প্রথম খলিফা

| প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে এস সিদ্দিকী
হিজরি ত্রয়োদশ বর্ষের ২২ জমাদিউসসানি ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর ওফাত দিবস প্রতি বছর আসে যায়, কেউ জানে, কেউ জানে না। এর গুরুত্ব কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। আর কেউ বুঝেও বোঝে না।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পরপরই ইসলামের ওপর যে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছিল তার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল ইসলামদ্রোহী, নাস্তিক, জাকাত অস্বীকারী, ভ- নবী এবং ইসলামে দুর্বল বিশ্বাসী ও ভ্রান্ত-বিকৃত চিন্তাধারার অধিকারী কিছু নও মুসলিম শান্তির ধর্ম ইসলামকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। বৈষয়িক, ব্যক্তি বা গোত্রীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তারা তলে তলে ইসলামের সর্বনাশে লিপ্ত থাকে। মুসলমানদের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওফাতকে তারা সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে এবং আরবের নানা স্থানে তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদের সাথে যোগ দেয় পৌত্তলিক অংশীবাদী ও মোনাফেক খলনায়করা। হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) প্রথম খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তার সামনে এসকল সমস্যা জটিল হয়ে দেখা দেয়।
খলিফা সিদ্দিকে আকবর সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান এবং খোদায়ী মদদের ওপর নির্ভর করে ইসলামের সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং এগুলোর মূলোৎপাটনে সশস্ত্র অভিযান শুরু করেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি সকল শত্রু-শক্তিকে নির্মূল করে ইসলামকে তাদের কবল হতে মুক্ত করেন এবং খেলাফতকে সুদূঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তার অপশক্তি দমনের সফল অভিযানগুলোর বিশদ বিবরণ সীরাত ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.)-এর খেলাফত আমলে বেশ কিছু বিজয়ও সূচিত হয়। তিনি একটি বাহিনী হজরত খালেদ ইবনে অলীদ (রা.)-এর নেতৃত্বে সাসানীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এ বাহিনী ‘হীরা’ এলাকা (ফোরাত নদীর পশ্চিমে) জয় করে। তিন সেনাপতির নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী উত্তর দিকে অগ্রসর হয় এবং তিনটি বিভিন্ন অংশে সিরিয়ার অভ্যন্তরে অগ্রসর হয়। রোম স¤্রাট বিশাল বাহিনীর সমাবেশ ঘটায় বলে খবর আসে। তখন খলিফা হজরত খালেদ (রা.)-কে সিরিয়ায় গমনের নির্দেশ দেন। মরু এলাকা অতিক্রম করে হজরত খালেদ (রা.)-এর সিরিয়ায় পৌঁছানোকে বিরাট সামরিক বিজয় হিসেবে গণ্য করা হয়।
সে সময় বিশ্বে দুটি বৃহৎ শক্তির আধিপত্য ছিল। উত্তর-পূর্ব রোম সা¤্রাজ্য, যার প্রধান কেন্দ্র ছিল কুসতুলিয়া বা কনসটান্টি সোপল। পূর্বে ছিল ইরানের সাসানীয় সা¤্রাজ্য। যে আরব গোত্র এ সা¤্রাজ্যগুলোর অধীনে ছিল। তারা ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তখন এসব সা¤্রাজ্যের কর্মকর্তারা তাদের দাবিয়ে রাখতে চায়। রোম স¤্রাট সীমান্তবর্তী আরব গোত্রদের ভাতা বন্ধ করে দেয়। এ জন্য তারা নিজেদেরকে স্বাধীন মনে করতে থাকে। সা¤্রাজ্যগুলোর পক্ষ হতে তাদের ওপর কঠোর নিপীড়ন শুরু হলে আশেপাশের মুসলিম আরব গোত্রগুলো তাদের ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকে। এভাবে একই সময় রোম ও ইরানের সাথে আরবদের বিভিন্ন লড়াই হয়। শক্তিহীন অস্ত্রহীন আরব মুসলমানগণ রোম-ইরানকে পরাভূত করার সূচনা করেন সিদ্দিকী আমলে।
হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) বয়সের দিক থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) অপেক্ষা দুই বছরের ছোট ছিলেন। তিনি মক্কার ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। বিদ্যা-শিক্ষা, জ্ঞানবুদ্ধি, অভিজ্ঞতা এবং চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে লোকেরা তাকে খুবই সম্মান করত। শুরু থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সুসম্পর্ক ও ভালোবাসা ছিল। তিনি ছিলেন আজাদ পুরুষদের মধ্যে প্রথম মুসলমান। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সমস্ত মাল দীনের সেবায় ব্যয় করেন। খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আবু বকরের মালের চেয়ে অধিক আমি কারো মাল দ্বারা উপকৃত হয়নি। তবুক যুদ্ধের প্রস্তুতির ঘোষণা হওয়ার পর হজরত আবু বকর (রা.) তার ঘরের সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত করেন। এমন কি জামার বোতাম পর্যন্ত পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করেন, ‘বালবাচ্চাদের জন্য কী রেখে এসেছ?’ বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূলকে’।
রাসূলুল্লাগ (সা.)-এর মেরাজের ঘটনায় হজরত আবু বকর (রা.) ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত হন। হিজরতের সময় সওর গুহায় রাসুলুল্লাহ (স:) এর সঙ্গে থাকার কারণে তাকে কোরআন ‘সানি ইসনাইন’ বা দুই এর দ্বিতীয় ঘোষণা করেছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে অন্তরঙ্গ বা অনন্ত সঙ্গী রূপে খ্যাত। আম্বিয়ায়ে কেরামের পর সিদ্দিকে আকবর (রা.) বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে খোদ রাসূল (সা.) বলেছেন।
হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.)-এর আরো সৌভাগ্য যে, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শ্বশুর এবং উম্মুল মোমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর পিতা এবং তার পিতা-পিতা উভয়ই ছিলেন সাহাবি। অর্থাৎ সিদ্দিকী পরিবারের তিন পুরুষই ছিলেন সাহাবি, যা এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। আর কোনো সাহাবি সম্পর্কে এরূপ দৃষ্টান্ত জানা যায় না। হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা)-এর শানে কোরআনের বেশ কিছু আয়াত নাজিল হয়।
ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সর্বপ্রথম যে খুতবা প্রদান করেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা সর্বমহলে স্বীকৃত। প্রদত্ত ভাষণে খলিফা বলেন : ‘হে লোক সকল! আমাকে তোমাদের ওপর শাসক বানানো হয়েছে, কিন্তু আমি সবচেয়ে উত্তম নই। আমি যদি ভালো করি, তাহলে তোমরা আমাকে সাহায্য করবে। যদি আমি মন্দ কাজ করি, তাহলে তোমরা আমাকে সঠিক পথে আনবে। সততা আমানতস্বরূপ, মিথ্যাচার খেয়ানতস্বরূপ। আমার কাছে দুর্বল শক্তিশালী, এমন কি আমি তার অধিকার ফিরিয়ে দেব। আমার কাছে শক্তিশালী দুর্বল, এমনকি অপরদের অধিকার তার দ্বারাই পাইয়ে দেব। যে জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ পরিত্যাগ করে, আল্লাহই তাকে অপমানিত অপদস্ত করেন। যে জাতির মধ্যে মন্দ কাজ আম হয়ে যায়, তাদের বিপদাপদও আল্লাহ আম করে দেন। আমি যদি আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হয়ে চলি, তোমরাও আমার অনুগত হয়ে চলবে। আমি খোদা ও রাসূলের অবাধ্য হলে তোমাদের উচিত হবে আমার অবাধ্য থাকা।’
খেলাফতকালে হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) সকল বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করতেন। রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলায় ভাগ করেন এবং প্রত্যেক স্থানে যোগ্য ও ভালো শাসক নিয়োগ করেন। কারো প্রতি কোনো দায়িত্ব অর্পণ করার সময় তাকে তার কর্তব্যও বুঝিয়ে দিতেন। খলিফা মদিনার বাইরে একটি গ্রামে বসবাস করতেন, মাসের পর মাস তিনি সেখান হতে হেঁটে আসতেন এবং মসজিদে বসে সরকারি কাজকর্ম পরিচালনা করতেন এবং সন্ধ্যোয় পদব্রজে গৃহে গমন করতেন। সিরিয়ায় সৈন্যদের প্রেরণের সময় তাদেরকে তাগিদ করে বলেছেন :
* কোনো শিশু বা বৃদ্ধ কিংবা কোনো নারীকে হত্যা করা যাবে না।
* ফলন্ত বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না,
* আবাদি স্থানকে বিরান করা যাবে না,
* কেবল খাবার জন্য পশু জবাই করা যাবে,
* গণিমতের মালের খেয়ানত করা যাবে না,
* কাপুরুষ হবে না এবং
* যে জাতির মধ্যে গমন করবে তাদেরকে ইসলামের দিকে বিনীতভাবে আহ্বান জানাবে। যেমন অমুসলিম ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে সম্মত হয়, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে বার্ষিক দশ দেরহাম গ্রহণ করবে। বৃদ্ধ, অবস, দরিদ্র প্রভৃতি শ্রেণির লোকদের জন্য উল্লিখিত হারের অর্থ গ্রহণ করা যাবে না, তা ক্ষমা-মাফ হিসেবে গণ্য হবে, বরং বায়তুল মাল হতে তারা ভাতাপ্রাপ্ত হবেন। হীরার খৃস্টানদের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল- তার কোনো কোনো শর্তে এ কথাও ছিল যে, তাদের খানকা গির্জা ইত্যাদি ধ্বংস করা যাবে না, এমন কোনো ইমারত ভাঙা যাবে না, যাতে তারা প্রয়োজনের সময় আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। তাদের ঘণ্টা বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়নি এবং তাদের উৎসবাদী ও মিছিলে ‘ছলীব’ বা ত্রুসসহ বের হতে বাধা দেয়া যাবে না।
হিজরি দ্বাদশ বর্ষে খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর নির্দেশক্রমে সর্বপ্রথম হজরত জাঈদ ইবনে সাবেত (রা.) কোরআন সংকলনের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগেই কোরআন সংকলনের কাজ পূর্ণ হয়েছিল।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ অভিযান প্রেরণের ঘটনা। কনিষ্ঠ বয়সী হজরত ওসামা ইবনে জাঈদ (রা.) ছিলেন এ অভিযানে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের ফলে অভিযানটি স্থগিত হয়ে যায়। হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে কালবিলম্ব না করে ওসামা অভিযান প্রেরণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এ অভিযান সফল হয়েছিল। এটি ছিল প্রথম খলিফার প্রথম অভিযান। জাকাত অস্বীকারকারী এবং মোরতাদ ও ভুয়া নবীদের দমনের কথা আগেই বলা হয়েছে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলিফা ছিলেন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। বিদায় হজের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) আশি (৮০) কিংবা একাশি (৮১) দিন জীবিত ছিলেন। ওফাতের চার দিন পূর্বে তিনি অসুস্থ অবস্থায় মাগরিবের নামাজ পড়ান, কিন্তু তিন বার চেষ্টা করেও এশার নামাজ পড়াতে পারেননি, অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। অতঃপর হজরত বকর সিদ্দিক (রা.)-কে নামাজ পড়াতে বলেন। ওফাত পর্যন্ত তিনিই নামাজ পড়াতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ হতে এটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে, ইসলামের প্রথম খলিফা হবেন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। অর্থাৎ তিনি ছিলেন হুজুর (সা.) কর্তৃক মনোনীত খলিফা।
(চলবে)


 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন