শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবায় সউদী আরব

শাহাদাৎ হুসাইন খান ফয়সাল | প্রকাশের সময় : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবা, উন্নয়ন ও স্বার্থ সংরক্ষণে সউদী আরবের অবদান অনস্বীকার্য। সউদী সরকার হাজী, উমরাকারী ও যিয়ারতকারীদের সুবিধার জন্য বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং বাস্তবায়ন করছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মক্কার মাসজিদে হারাম সম্প্রসারণ, মদীনায় মাসজিদে নববী সম্প্রসারণ, মাস’আ অর্থাৎ সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সা’ঈর পথ প্রশস্তকরণ, মীনায় জামারাতে পাথর নিক্ষেপের পথে ব্রিজ তৈরিকরণ, জেদ্দা-মক্কা-মদীনা রেলপথ তৈরি এবং বিশেষ করে হজ্জের বিধান পালনের সাথে সম্পৃক্ত স্থানগুলোর মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকিকরণ ইত্যাদি
সউদী আরব শুধু হারামাইনের খেদমতেই নিজেেেক সীমাবদ্ধ রাখছে না। দেশটি সারা দুনিয়ায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারেও সাধ্যানুযায়ী অবদান রেখে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে কুরআনকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাদশাহ ফাহাদের নিজস্ব উদ্যোগে ১৪০৩ হি. সালে মদিনা মুনাওয়ারার তাবুক রোডের পাশে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার জমির ওপর ‘মুজাম্মা আল-মালিক ফাহ্দ লি-তাবা’আতিল মুসহাফ আশ-শারীফ’ বা ‘বাদশাহ ফাহদ কুরআন প্রিন্টিং প্রেস’ প্রতিষ্ঠত হয়, যা ১৪০৫ হি. সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। এই সংস্থা থেকে বছরে ৭০ লক্ষ কপি কুরআন ও বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষাগুলোসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা কপি ছাপানো হয়। এই সংস্থা থেকে ক্যাসেট, সিডি করেও কুরআন বিতরণ করা হয়। আর এই সংস্থাটি এখন হয়ে উঠেছে কুরআন গবেষণার প্রাণকেন্দ্র।
সউদী আরব শুধু ইসলামের প্রচার-প্রসারে অবদান রাখছে তা নয়, বরং তারা মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন স্বার্থেও তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নিরক্ষরতা, অপুষ্টি, রোগ-বালাই, দারিদ্র্য, পরিবেশ বিপর্যয় ইত্যাদি দূরীকরণে সাহায্য-সহযোগিতার অব্যাহত রেখেছে।
ইসলামী সংহতির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সউদী আরব। এরই ধারাবাহিকতায় সউদী আরবের উদ্যোগে ১৯৬২ সালে ‘রাবিতাতুল আলাম আল-ইসলামী’ বা ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ’ ও ১৯৬৯ সালে ‘মুনাযযামাতুত তা’আউন আল-ইসলামী’ বা ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’ (ওআইসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও সউদী আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও অনেক ইসলামিক সেন্টার ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা ও অর্থায়ন করে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে।
সউদী আরব সারা দুনিয়ায় সামাজিক ও মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারা এই কাজের জন্য অনেকগুলো সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব সংস্থার মাধ্যমে তারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে মানবিক সাহায্য প্রদান করে থাকে। সেসব সংস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: হাইআতুল ইগাছা আল-ইসলামিয়্যাহ আল-আলামিয়্যাহ (আন্তর্জাতিক ইসলামী ত্রাণ সংস্থা- আইআইআরও), আন-নাদওয়াতুল আলামিয়্যাহ লিশ-শাবাব আল-ইসলামী (ওয়ার্ল্ড এসেম্বলি অফ মুসলিম ইওথ- ওয়ামী), আল-হাইআইতুস সউদীয়্যাহ লি-জামঈত তাবাররু’আত, সুনদূকুত তাযামুনিল ইসলামী বা ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ড, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বসনিয়া হার্জেগোভিনায় মুসলমানদের জন্য সাহায্য সংগ্রহের উচ্চ কমিটি, বাদশাহ ফয়সাল ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। এসব সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১. বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট নানাবিধ দুর্যোগে আক্রান্তদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আর্থিক সাহায্য দান ও পুনর্বাসন; ২. কৃষি স¤প্রসারণ; ৩. বাঁধ নির্মাণে কারিগরি সহায়তা দান; ৪. কূপ খনন; ৫. বিচ্ছিন্ন স্থানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন; ৬. ক্লিনিক স্থাপন; ৭. স্বাস্থ্যসেবা দান ইত্যাদি মানবিক সেবা প্রদান করা এ সংস্থাগুলোর মূল দায়িত্ব।
সউদী আরবের অসংখ্য মানবসেবামূলক প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে অমুসলিম দেশে অবস্থিত সংখ্যালঘু মুসলমানদের নানাবিধ সেবা প্রদান করা। গত কয়েক দশক ধরে সউদী আরব অমুসলিম সমাজে ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় প্রয়োজন মেটাতে এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জোরদার করতে অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তারা সারা বিশ্বে বিশুদ্ধ ইসলামী আকীদা ও আমল ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক সেন্টার, ইনস্টিটিউট ও গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এক হিসাবে দেখা যায় তারা নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলস, সানফ্রান্সিসকো, শিকাগো, মাদ্রিদ, লন্ডন, রোম, প্যারিস, বন, ব্রাসেলস, জেনেভা, টোকিও, টরেন্টো, ভিয়েনা, লিসবন, বুয়েন্স আয়ারস, এডিনবরা এবং রিওডি জেনিরোসহ বিভিন্ন মুসলিম ও অমুসলিম দেশের বহু শহরে ১৫০০টি মসজিদ ও ২১০টি ইসলামী সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণে সউদী আরবের অর্থায়নের কথা রয়েছে।
সউদী আরব শুধু বিশ্বব্যাপী মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মাণ করেই থেমে থাকেনি। বরং যেখানেই মুসলমানরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছে, সেখানেই তাদের পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়েছে। নিচে কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো:
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সউদী আরব এবং এর ইসলামী সংস্থাগুলো মধ্য এশিয়ার নব সৃষ্ট মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোকে সাহায্যের ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। সউদী আরব অতি দ্রæত পদক্ষেপ নিয়ে ছয়টি মুসলিম প্রজাতন্ত্রের রাজধানীতে বিশাল বিশাল ইসলামিক সেন্টার স্থাপন করেছে এবং প্রজাতন্ত্রগুলোর ছোট শহরগুলোয় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে। একই সঙ্গে স্থানীয় ভাষায় অনূদিত এবং মদীনার বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্সে মুদ্রিত লাখ লাখ কপি কুরআনুল কারীম বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বিমানযোগে ওইসব দেশের মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারগুলোতে প্রেরণ করা হয়েছে।
ইসলামের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এবং ইসলামের সঠিক জ্ঞান প্রচারার্থে সউদী আরব নিজস্ব অর্থায়নে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামী শিক্ষা বিভাগ ও চেয়ার প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলমানরা যখন সার্ব বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকার হয়, তখন সউদী আরব সেখানকার মুসলিমদের অনেককে সউদী আরবে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে সাহায্য করার জন্য ‘বসনিয়া হার্জেগোভিনায় মুসলমানদের জন্য সাহায্য সংগ্রহের উচ্চ কমিটি’ গঠন করে এবং এর মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য সংগ্রহ করে তার নিপীড়িত মানুষের মাঝে বিতরণ করে।
২০১২ সালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা গণহত্যার শিকার হলে সউদী আরব ওআইসির চতুর্থ বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে ও তাদের জন্য ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদানের ঘোষণা করে। সউদী আরব বিগত ৭০ বছর যাবৎ রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাহায্য-সহযোগিতা করছে। ইতোমধ্যেই সউদী আরব দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে নিজ দেশে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে এবং অসংখ্য আরাকানীকে নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জাতিগত নির্মূল অভিযানে ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১২৩ কোটি টাকা) ত্রাণ হিসেবে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন সউদী বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আযীয আলে সাউদ। এর আগেও চার হাজার কোটি টাকা দেয়ার ঘোষণা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সউদী প্রেস এজেন্সির সূত্রে আরব নিউজ, সউদী গেজেটসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই সংবাদ প্রকাশ করে। সউদী রয়েল কোর্টের উপদেষ্টা ও রিয়াদভিত্তিক কিং সালমান সেন্টার ফর রিলিফ এন্ড হিউমেনিটারিয়ান ওয়ার্ক-এর জেনারেল সুপারভাইজার ড. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আযীয আল-রাবীআহ আরও ঘোষণা করেন যে, সেন্টারের পক্ষ থেকে খুব দ্রæত একটি বিশেষ টিম বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য যাচ্ছে এবং তাদের জরুরিভিত্তিতে যে সকল সাহায্য দরকার তার তালিকা করবে। যাতে করে সাহায্যের পরবর্তী ধাপে জরুরি সাহায্যগুলো পাঠাতে পারে। আর এই সাহায্য মূলত দীর্ঘমেয়াদী সাহায্য কার্যক্রমের প্রথম অংশ। এই কার্যক্রম চলতে থাকবে এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন-এর সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করবে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আসতে এবং খাওয়া-দাওয়াসহ চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি অনুরোধ করে সউদী আরব। এবং সেই খরচ সউদী সরকার বহন করারও ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই ৫০ টন খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসক পাঠানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন সউদী বাদশাহ। সউদী মন্ত্রিসভার মিটিং-এ আবারও মিয়ানমারে বসবাসরত মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা বন্ধে ও তাদের মৌলিক মানবাধিকার ফিরিয়ে দিতে মায়ানমারকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়ায় রাবেতা হাসপাতালসহ রাখাইনে বেশ কিছু হাসপাতাল, মসজিদ, মাদরাসা নির্মাণ করে দিয়েছে সউদী আরব। সব কিছুই প্রধানত রাবেতাতুল আলম আল-ইসলামীর মাধ্যমে করেছে সউদী আরব।
সউদী আরবের বর্তমান বাদশাহ খাদিমুল হারামাইন আশ-শারীফাইন সালমান বিন আব্দুল আযীয আলে সাউদ, ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুহাম্মাদ বিন সালমান-এর নেতৃত্বে সউদী আরব আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এক নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তারা ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
লেখক: গবেষক, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইনস্টিটিউট ফর এডুকেশন এন্ড রিসার্চ, উত্তরা, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন